ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

নিসর্গ প্রেমী দ্বিজেন শর্মা

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিসর্গ  প্রেমী দ্বিজেন শর্মা

রুহুল আমিন : দ্বিজেন শর্মা, একজন প্রকৃতিবিদ, জীববিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক, অনুবাদক, শিক্ষক—বিচিত্র তার পরিচয়। পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। আজ ২৯ মে গুণি এই মানুষটির ৮৮ তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন।

দ্বিজেন শর্মা ১৯২৯ সালের ২৯ মে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম চন্দ্রকাণ্ড শর্মা। চন্দ্রকাণ্ড গ্রাম্য কবিরাজ ছিলেন। আর মায়ের নাম মগ্নময়ী দেবী। মগ্নময়ী সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত।

বাবা ভিষক বা গ্রাম্যভাষায় কবিরাজ ছিলেন বলে দ্বিজেন শর্মা বাড়িতেই দেখেছেন নানা লতা-পাতা আর বৃক্ষের সমাহার। ছোট বেলায় সুযোগ পেয়েছেন আরণ্যক নিসর্গে ঘুরে বেড়ানোর। গাছ-পালার প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসার জন্ম বোধ হয় সেখান থেকেই শুরু তার।

গ্রামের পাঠশালায় তার পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়। তারপর করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু সেই ছোটবেলায় প্রকৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন দ্বিজেন শর্মা। উদ্ভিদবিজ্ঞানই তাকে আকৃষ্ট করে বেশি।  কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (১৯৫৮) ডিগ্রি নেন।

পড়াশোনা শেষ করে একই বছর তিনি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন তিনি। তারপর ঢাকাস্থ নটরডেম কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনীতে অনুবাদকের চাকরি নিয়ে চলে যান মস্কোতে। চল্লিশটিরও বেশি বই তিনি অনুবাদ করেছেন। তবে ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে অনুবাদ বন্ধ করার নির্দেশ পান তিনি প্রকাশনী থেকে। সেই থেকে রাশিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক চুকে যায় তার। কিন্তু ১৭ বছরের প্রবাস জীবনকে কখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি তিনি।

বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তার ছিল পরোক্ষ সংযোগ। আর এই কারণে কিছুকাল আত্মগোপনেও ছিলেন। হয়েছে কারাবাসেরও অভিজ্ঞতা। অবশ্য তিনি এই কারাবাসকে দুর্লভ সৌভাগ্য বলে মনে করতেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতাজাত যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তা পুঁজিবাদি বিশ্বের সোভিয়েত গবেষক পণ্ডিতদের চেয়ে আলাদা। এসব বিষয় নিয়ে তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ ও স্কেচধর্মী লেখা লিখেছেন।  ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবাকার্যে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন বাংলাদেশে।

নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ উদ্ভিদবিদ, নিসর্গ প্রেমী, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ দ্বিজেন শর্মা সেই প্রজন্মের মানুষ, যারা উপমহাদেশের বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু এতোসব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও তিনি কখনো প্রকৃতির কথা ভুলে যাননি। নিজের ভেতর সব সময় অনুভব করেছেন প্রকৃতির প্রতি গভীর এক মমত্ববোধ। তাই  বলে এমন না যে, উদ্ভিদ বিজ্ঞানে পড়ে বেরসিক ছিলেন তিনি। কেবল প্রকৃতিতেই মগ্ন ছিলেন না, শিল্পবোধ আর দেখার চোখ, সুন্দরকে অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা চিরজীবনের তার। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। আড্ডা, বিশেষ করে তরুণদের সঙ্গে আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করেন তিনি।

দ্বিজেন শর্মা কেবল নিসর্গে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজের দায় শেষ মনে করেননি। পরিবারের প্রতি নিজের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৬০ সালে বরিশালে দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. দেবী শর্মা ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের দর্শনের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার স্বপ্নময়তার শুরু হয়েছিল। এখন তারা বড় হয়েছে, ছোট্ট চারা গাছ থেকে পরিপক্ক গাছ হয়েছে তার যত্নে, তার পরিচর্যা ও ছায়াতে। পরিবারের অনেকটা সময় কেটেছে মস্কোতেই।  ছেলে ডা. সুমিত শর্মা রুশ দেশে বিয়ে করে সংসার সাজিয়েছেন মস্কোতে। আর একমাত্র মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা বাস করেন বাংলাদেশেই।

প্রকৃতি প্রেমের পাশাপাশি তিনি অনুবাদ ও মৌলিক লেখাও লিখেন। লেখালেখির মধ্যেই তার সৃষ্টিশীলতা ফুটে উঠেছে বার বার। জীবনের প্রথম লেখা ছিল একটি গল্প। ১৯৪৯ সালে তিনি তখন আই.এস.সি. ক্লাসের শেষবর্ষের ছাত্র। কলেজ বার্ষিকীতে ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছিল সেই গল্পটি। সেটি ছিল একটি আত্মজীবনীমূলক গল্প। এক দরিদ্র ছাত্রের শিক্ষালাভের কঠোর সংগ্রামের কাহিনী। এরপর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে তার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর বিষয়বস্তুও ছিল অভিন্ন, দারিদ্র্যের জীবনযুদ্ধ।

তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহগুলো হলো-শ্যামলী নিসর্গ, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণি বিন্যাস, ফুলগুলি যেন কথা, গাছের কথা ফুলের কথা, এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি, নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, সমাজতন্ত্রে বসবাস, জীবনের শেষ নেই, বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ, ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা, গহন কোন বনের ধারে, হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার, বাংলার বৃক্ষ, সতীর্থ বলয়ে ডারইউন, মম দুঃখের সাধন, আমার একাত্তর ও অন্যান্য।

দ্বিজেন শর্মা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংস্থা থেকে সংবর্ধিত হয়েছেন। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। তার প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ড. কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ভাষা ও সাহিত্যে পেয়েছেন একুশে পদক। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে এম নুরুল কাদের শিশু-সাহিত্য পুরস্কার এবং চ্যানেল আই প্রবর্তিত প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমির একজন সম্মানিত ফেলো।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়