ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আধুনিক বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞানের জনক

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ৩ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আধুনিক বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞানের জনক

হাসান মাহামুদ: ‘সদাশিব’ বলে বাংলায় যে শব্দ রয়েছে, তার অর্থ সদা-বিনম্র, অল্পেই তুষ্ট। অতি উদার বা অনুকূল, সর্বদা সন্তুষ্ট এসব অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কথাটি যেন অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরিই প্রযোজ্য। এমন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন তিনি।

তার মধ্যে ছিল সৃষ্টিসুধা, জীবনের আনন্দ। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই বোধ সঞ্চারে তিনি নিবেদিত ছিলেন, ভাষার ধ্বনি সঞ্চারেও ছিলেন নিবেদিত। এমন মন্ত্রই তিনি সঞ্চার করে গেছেন অকাতরে। এ জন্য তিনি আজো বাংলা ভাষার কাছে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চির অমর।

মুহম্মদ আবদুল হাই ছিলেন শিক্ষাবিদ, ধ্বনিতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালির শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ ও মমতা। বাংলা ভাষার বিভিন্ন ধ্বনির গঠন, উচ্চারণ ও ব্যবহার বিধির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে এ ক্ষেত্রে যে পাণ্ডিত্যের পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা তুলনাহীন। এই তাকে এই উপমহাদেশের ‘আধুনিক বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। তিনি শুধু একজন ভাষাবিজ্ঞানী, ধ্বনিবিজ্ঞানী ও গবেষকই ছিলেন তা নয়, চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবেও বেশ সুনাম ছিল তার।

বাংলা ভাষার উৎকর্ষ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের অবদান অনবদ্য। দেশের একজন কৃতী শিক্ষক ও খ্যাতনামা ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে মুহম্মদ আবদুল হাই নন্দিত ছিলেন। বিভাগোত্তর বাংলাদেশে যেসব চিন্তাবিদ আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি তাদের অন্যতম। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির আশ্রয়ে ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিনি ছিলেন পথিকৃত। সাহিত্যের গবেষণা সংগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে মুহম্মদ আবদুল হাই গড়ে তুলেছিলেন অনন্য পরিবেশ। তার সম্পাদিত ‘সাহিত্য পত্রিকা’ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে এখনো বিবেচিত।

মুহম্মদ আবদুল হাই ১৯১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর বুধবার রাত দশটায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচাগ্রাম। তার পুরো নাম আবুল বশার মুহম্মদ আবদুল হাই। তার বাবা আবদুল গণি, মা মায়মুন্নিসা খাতুন।

মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা, ইংরেজি, আরবি, সংস্কৃত, উর্দু ও প্রাথমিক ফরাসি এই ছয়টি ভাষা জানতেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব, ছন্দ, অলঙ্কার ও ব্যাকরণ, মধ্যযুগীয় ভক্তি সাহিত্য ও পুঁথি সাহিত্য, আধুনিক বাংলা গদ্য ও কবিতা, বাংলা নাটক, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের কবিতা পড়াতেন।

তার নীরব সাধনা ও নিরলস কর্মতৎপরতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ অচিরেই সুশৃঙ্খল, সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুখ্যাতিসম্পন্ন একটি বিভাগে পরিণত হয়। মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা বিভাগকে যোগ্য শিক্ষক দ্বারা সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. আনিসুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো শিক্ষককে তিনি এই বিভাগে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পঠন পাঠন ব্যাপকতা লাভ করে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতি ও এই সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে নীতি নির্ধারণ ও আলোচনা-পরামর্শ করার তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে মুহম্মদ আবদুল হাই এসব তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ভাষা আন্দোলনের পর শাসকশ্রেণির বিরূপ মনোভাবের কারণে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সঙ্কটের মধ্যে পড়ে। আরবি হরফে বাংলা লেখন, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অধিক প্রয়োগ, বাংলা সাহিত্য থেকে ’হিন্দুয়ানি’ বিষয় বর্জন, রবীন্দ্র-সঙ্গীত প্রচার বন্ধ, এমনকি কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা-সঙ্গীত প্রচাররোধ-এরকম বিতর্কিত কর্মকান্ড শুরু হয়। সংস্কৃতির এ দুর্দিনে দৃঢ়চিত্ত আবদুল হাই পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেন।

১৯৫৫ সালে পূর্বতন ইন্ডিয়া অফিসের সম্পদ হস্তান্তর বিষয়ক কমিটিতে পাকিস্তান সরকারের আহ্বানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে শিক্ষা-উপকরণ তৈরির বিশেষজ্ঞ কমিটিতে তার ডাক পড়ে। নবগঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে প্রার্থী নির্বাচন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, প্রশ্নপত্র সমন্বয় প্রভৃতি কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও ঢাকা বোর্ডের শিক্ষা ও পাঠক্রম সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫৭ সালের ১৯ থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত করাচীতে অনুষ্ঠিত ভাষা-শিক্ষা বিষয়ক কনফারেন্সে তিনি যোগদান করেন। ঐ বছরই পুনার ডেকান কলেজে অনুষ্ঠিত ভাষাতত্ত্ব সেমিনারেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় যোগ দিতে তিনি মাদ্রাজে আন্নামালাই নগরে যান। এগুলি ছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তবে তিনি শুধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই নয়, দেশের নানাবিধ ছোট খাটো সাংস্কৃতিক সভাসমিতিতেও যোগদান করেন। 

বাংলা ভাষার ধ্বনির গঠন, উচ্চারণ ও ব্যবহারবিধি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে রচিত তার ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব গ্রন্থটি মুহম্মদ আবদুল হাইকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। গ্রন্থটির বর্ণনাভঙ্গি বিজ্ঞানানুগ, এর ভাষাভঙ্গি ও রচনাকৌশল বিবেচনায় এখানে নিরস তত্ত্বকথাও রসপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ পাঠকও সহজে আকৃষ্ট হয়। ভাষাতত্ত্বের মৌলিক বিষয় নিয়ে এরূপ উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ দুই বাংলার মধ্যে তিনি প্রথম রচনা করেন। ধ্বনিবিজ্ঞানী হিসেবে গ্রন্থটি তাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়।

পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করার জন্য মুহম্মদ আবদুল হাই সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে যৌথভাবে রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ, ১৯৬৮)। অপরদিকে আহমদ শরীফ, মনসুরউদ্দীন, আনিসুজ্জামান ও আনোয়ার পাশার সহযোগে মধ্যযুগের পুঁথি, লোকসাহিত্য এবং আধুনিক যুগের গদ্য ও পদ্য গ্রন্থের সংকলন ও সম্পাদনা প্রকাশ করেন।

মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের অপর উল্লেখযোগ্য অবদান- বাংলা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ (২২-২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩) পালন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা এবং নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা। আয়োজনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছিল এবং তা সকল শ্রেণির মানুষের মনে বিপুল সাড়া জাগায়।

বাংলা একাডেমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগে এই ভাষাবিজ্ঞানীর বিভিন্ন সৃষ্টিকর্ম সংরক্ষণ করেছে। বাংলা একাডেমি লেখক মনসুর মুসার লেখা ‘মুহম্মদ আবদুল হাই’ গ্রন্থটি ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করে। এতে এই শিক্ষক ও ভাষাবিজ্ঞানীর বিভিন্ন তথ্য ও তার উদ্ভাবিত ভাষার বিভিন্ন ধ্বনিসংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

১৯৬৯ সালের আজকের দিনে (৩ জুন) রেল দূর্ঘটনায় এই ভাষাবিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে এই ভাষাবিজ্ঞানীর জীবনাবসান না হলে নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব আরো বিস্তৃতভাবে উদ্‌ঘাটিত হতো। মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান মনীষীকে জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

লেখক: সাংবাদিক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুন ২০১৭/হাসান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়