ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ব্রিটেনে প্রথম মসজিদ করেছিলেন যিনি

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৪ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ব্রিটেনে প্রথম মসজিদ করেছিলেন যিনি

আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম

শাহেদ হোসেন : ১৮ শতকে তুরস্কের ওসমানী সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণুতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও বিস্তার থমকে যেতে শুরু করে। তবে ইসলামের অনাবিল সৌন্দর্য্য আর ভ্রাতৃত্ববোধে মুগ্ধ হয়ে অনেকে স্বউদ্যোগে এই ধর্মকে গ্রহণ করেছেন এমনকি প্রচারও করেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য গণগণে হয়ে প্রায় সারা বিশ্বে তাপ ছড়াচ্ছিল, তখন উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম নামের এক ইংরেজ তরুণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তুরস্কের সুলতান ও মুসলিম খেলাফত ব্যবস্থাকে সমর্থণ জানিয়ে স্বদেশীদের কাছে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা পর্যন্ত পেয়েছেন। ব্রিটেনে সর্বপ্রথম মসজিদ তিনিই নির্মাণ করেছেন।

১৮৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মেথডিস্ট পরিবারের জন্ম হেনরি কুইলিয়ামের। লিভারপুল ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা শেষে ১৮৭৮ সালে তিনি আইন পেশায় প্রবেশ করেন। আদালতে কুইলিয়ামের প্রভাব এতোটাই বেশি ছিল যে, লিভারপুল উইকলি ক্যুরিয়ার নামে স্থানীয় একটি সাময়িকী তাকে ‘লিভারপুলের অনানুষ্ঠানিক অ্যাটর্নি জেনারেল’ আখ্যা দিয়েছিল। বেশ জটিল কিছু হত্যা মামলা লড়ে আইনজীবী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি।

১৮৭৯ সালে হান্নাহ জনস্টোনকে বিয়ে করেন কুইলিয়াম। রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনামলে ইংল্যান্ডের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা দেখে হতাশ ছিলেন কুইলিয়াম। বিয়ের কয়েক বছর পর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে মরক্কো ভ্রমণে যান তিনি। আর এই সফরই তার জীবনে বয়ে আনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাওয়া। ইসলাম ধর্মে মুগ্ধ হয়ে তিনি কুরআন ও ইসলামের ইতিহাস পড়া শুরু করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি মরক্কোতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম পাল্টে রাখেন আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম।

ইংল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে নেমে পড়েন। ইসলাম ধর্মকে ব্রিটিশ জনগণের কাছে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে একের পর এক বই লিখতে শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি দ্য ক্রিসেন্ট নামে একটি সাপ্তাহিক সাময়িকী প্রকাশ ও সম্পাদনা শুরু করেন। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত এই সাময়িকীটি ছিল ব্রিটেনে মুসলমানদের মুখপত্র।

আফগানিস্তানের তৎকালীন যুবরাজ নসরুল্লাহ খানের কাছ থেকে অনুদান পেয়ে লিভারপুলের ৮, ব্রংহাম টেরেস ঠিকানার বাড়িটি কিনে ফেলেন আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম। এখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লিভারপুল মুসলিম ইনস্টিটিউট। এই বিশাল ভবনেরই একটি অংশে তিনি ব্রিটেনের প্রথম মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম অমুসলিম এতিম শিশুদের জন্য মদিন হাউজ নামে একটি এতিমখানাও চালু করেন। এসব শিশুদের তিনি ইসলামি মূল্যবোধে শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেন।

আব্দুল্লাহ কুইলিয়ামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানী নসরুল্লাহ ওয়ারেন, হাসেম উইল্ডি, স্ট্যালিব্রিজের সাবেক মেয়র রেসচেদ পি স্ট্যানলি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এছাড়া তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিসহ প্রায় ৬০০ নারী পুরুষ কুইলিয়ামের প্রচেষ্টায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, জাপানের প্রথম মুসলিম ব্যক্তিটিও কুইলিয়ামের হাত ধরে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন।

ব্রিটেনে ইসলাম ধর্ম প্রচার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তুরস্কের ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ খলিফা সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ১৮৯৪ সালে আব্দুল্লাহ কুইলিয়ামকে ‘ব্রিটেনের শায়খ’ বা ব্রিটেনের মুসলমানদের নেতা উপাধি দেন। আফগানিস্তানের আমিরও একই উপাধি দেন কুইলিয়ামকে। আর ইরানের শাহ তাকে নিয়োগ দেন লিভারপুলে পারস্যের ভাইস কাউন্সেল হিসেবে।

কুইলিয়াম শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারকের কাজই করেননি, তার প্রকাশিত দ্য ক্রিসেন্ট সাময়িকীতে নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে তুরস্কের সঙ্গে ব্রিটেন যে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি।

ব্রিটেনের সঙ্গে আফগানিস্তানের বৈরি সম্পর্ক থাকা সত্বেও দেশটির আমিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো ভালো। এছাড়াও মুসলিম নেতা হওয়ার সুবাদে ইরানের শাহের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক ছিল। এসব কারণে ব্রিটেনের লিভারপুলের খ্রিস্টান নেতারা কুইলিয়ামকে বিশ্বাসঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এসময় ব্রিটেনে মুসলিম আইন অনুযায়ী কয়েকজন তরুণ-তরুণীর বিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে ১৯০৮ সালে ব্রিটেন ছেড়ে তুরস্কে চলে যান কুইলিয়াম। ১৯১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ব্রিটেনে ফেরেন তিনি। এসময় নিজের নাম পাল্টে রাখেন হারুন মুস্তফা লিয়ন।

১৯৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।উয়োকিংয়ের কাছে ব্রুকউডে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র :
১. লয়েল এনিমিস : ব্রিটিশ কনভার্টস টু ইসলাম, ১৮৫০-১৯৫০ : জ্যামি জিলহ্যাম (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)।

২. আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম ডটঅর্গ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুন ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়