ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঈদ পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৬ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদ পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : ঈদে কত মানুষ ঢাকা ছেড়েছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। কেউ বলছে ৪০ লাখ, কেউ ৫০ লাখ। ঢাকা সিটি করপোরেশনের হিসাবে, রাজধানীর ১ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকই ঢাকা ছেড়েছে। এটা শুধু ঢাকার হিসাব, এর বাইরে আরো সাতটি বিভাগ এবং ৬৪টি জেলা শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে গেছে। বলা চলে শহরের অর্ধেক মানুষ এখন গ্রামে।

ঈদের আগে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার এবং ঈদের পরে ফিরে আসার যে ঝক্কি-ঝামেলা, কষ্ট-ক্লেস তা সবাই কম-বেশি জানে। তারপরও মানুষ যায় দলে দলে ট্রেনে-বাসের ছাদে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেন যায়? এত কষ্ট-ক্লেস তারপরও অজানা ভালোলাগা তাদের মধ্যে বিরাজ করে। দুই ঘণ্টার পথ ১০ ঘণ্টায় গিয়েও আপনজনের সান্নিধ্যে পৌঁছানোর পর নিমিষে ভুলে যায় সব কষ্ট।

শহরের জীবনে ছুটতে ছুটতে মানুষ যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন ঈদ নগরের মানুষকে স্বস্তি এনে দেয়। আবদ্ধ জীবন থেকে গ্রামের মুক্ত বাতাসে বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আবার নতুন উদ্যেমে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি সঞ্চার করতে পারে। 

এই দুটি ঈদ আছে বলেই হয়ত গ্রামের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের সুযোগ মেলে। বছরে একটি বারের জন্য হলেও দেখা হয়, কথা হয়। গ্রামের আপনজনের জন্য যে উপহার নিয়ে যায়, অর্থের বিচারে সেটা হয়ত তেমন কিছু নয়, কিন্তু এটা যে কত বড়- তা পাওয়ার পর ওই মানুষটির মুখের হাসিতে ফুটে ওঠে। যতদিন তিনি পোশাকটি ব্যবহার করেন, তার সঙ্গে একটা ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে। হৃদয়ের বন্ধনকে করে দৃঢ়।

ঈদে যে কয় কোটি মানুষ গ্রামে যায়, তারা শুধু যে ভালোবাসা আর হৃদ্যতা বয়ে নিয়ে যায় তা কিন্তু নয়। কয়েক দিনের জন্য হলেও গ্রামে যায় অর্থনীতি। এতে গ্রামে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। গ্রামের মানুষেরা কিছুটা স্বচ্ছলতা পায়। ৫০ টাকার ভ্যান ভাড়া ৭০ টাকা পেয়ে যে উচ্ছ্বাসের দেখা মেলে, তা অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না।

ঈদে শহরে বা গ্রামের সব বাড়িতে খাবারের বাড়তি আয়োজন থাকে। যারা  অবস্থাপন্ন তাদের বাড়িতে একটু বেশিই থাকে। সকালে সেমাই-মিষ্টি থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত কম-বেশি আয়োজন থাকেই। ঈদে নামাজ পড়ার পর পাড়ার ঘরে ঘরে দল বেঁধে সেমাই খাওয়ার ধুম পড়ে। এরপর আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। যে স্বজনটির সঙ্গে দীর্ঘ সময় দেখা নেই, তারও বাড়িতে গিয়ে হাজির। দেখা মেলে, কথা হয়। গ্রামের অভাবি মানুষটি ফিতরা বা যাকাত পেতে বছরের দু-একটি দিন অন্তত কিছুটা ভালো থাকার চেষ্টা করে।  

ঢাকা শহরে আমার চেনা-জানা একটি পরিবারের ঈদের গল্প বলি। পরিবারটি পৈতৃকসূত্রে পাওয়া একটি ভবনের কয়েকটি ফ্ল্যাটে বসবাস করে। ওই পরিবারের অভিভাবক বা মুরব্বি সবাই বড় বোন এবং তার স্বামী। দুলাভাই ভদ্রলোকের পাঁচ শ্যালক এবং এক শ্যালিকা সবাই বিবাহিত এবং ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকে। উনার সঙ্গে থাকে ছেলে-বৌমা এবং দুই নাতনি। পাশের ভবনে থাকে তার মেয়ে-জামাতা এবং এক নাতনি।

বছরের দুটি ঈদে নাতনি, শ্যালিকা-শ্যালক এবং তাদের বৌদের আবদার মেটাতে অভিভাবক দুলাভাইয়ের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। এই দুই দিন কোনো ফ্ল্যাটে রান্না হয় না, ভাইয়ের বৌদের সহযোগিতায় রান্না করেন বড় বোন। সব বাজার অবশ্য নিজের পকেটের টাকায় অভিভাবক দুলাভাইকেই করতে হয়।  তবে শুধু বাজার খরচেই কিন্তু তার পরিত্যাণ মেলে না; নাতনি, শ্যালিকা, শ্যালক, শ্যালকের বৌদের সালামি দিতে দিতে পাকেট ফাঁকা হয় যায়।

এরপর কয়েক দিন ধরে চলে প্রত্যেকের বাসায় পর্যায়ক্রমে দাওয়াত খাওয়া। ঈদের সৌন্দর্য সম্ভবত এখানেই। সম্পর্ককে ঝালাই করে নিয়ে নতুন করে আবার চলা শুরু করা।

ঈদে শুধু আত্মীয়-স্বজন নয়, নিজ বংশের যে মানুষটি গত হয়েছেন, তাকেও স্মরণ করা হয়। গ্রামে ঈদের নামাজের পর বংশের মুরব্বিরা সবাই পারিবারিক কবরস্থানে যান। তারা বংশের মৃত মানুষদের স্মরণ করেন। তাদের রুহের মাগফিরাতের শান্তি কামনায় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন। 

এক মাস রোজা শেষে আকাশে যখন ঈদের চাঁদ দেখা যায়, সবার মনে তখন পুলক জাগে। ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবার মন অনাবিল প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। এটা ঐশ্বরিক দান। কিন্তু এই আনন্দ আমাদের সংকীর্ণতায় নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলি। আমরা যদি হাতটা একটু প্রসারিত করি, তাহলে আনন্দে শামিল হতে পারে সবাই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৭/বকুল/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়