ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হুমায়ূন আহমেদ এবং শ্রাবণ দিনের কৌতুক

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৪, ১৯ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হুমায়ূন আহমেদ এবং শ্রাবণ দিনের কৌতুক

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

|| তাপস রায় ||

হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। থাকেন সেখানেই। নতুন গাড়ি কিনেছেন। গাড়ি প্রতিদিন প্রভোস্টের বাসার সামনে রেখে দেন। জায়গাটা নিচু।

একদিন সকাল থেকে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামল সন্ধ্যার একটু আগে। বৃষ্টির কারণে প্রভোস্ট সারাদিন বাসায় ছিলেন। বৃষ্টি থামতেই তিনি বের হলেন। গেটের সামনে ততক্ষণে পানি জমে গেছে এবং সেই পানিতে গাড়ির অর্ধেক প্রায় ডুবে আছে। প্রভোস্ট হুমায়ূন আহমেদের কাছে লোক পাঠিয়ে এই দুঃসংবাদ তাঁকে জানানোর ব্যবস্থা করলেন।

বার্তাবাহক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদকে ঘটনা জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতেই তিনি স্থিরচিত্তে বললেন, আমি জানি। সকাল থেকেই জানালার পাশে বসে গাড়ির দুর্দশা উপভোগ করছি। আস্তে আস্তে পানি উপরের দিকে উঠছে আর গাড়িটি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। এ এক বিরল দৃশ্য!

জানালার পাশে বসে গাড়ির দুর্দশা কতটা উপভোগ্য জানি না, তবে বৃষ্টি উপভোগ করা যায়। একদিন এমনই এক বৃষ্টির দিনে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা জানালার পাশে বসে ছিলেন। তিনি একজনকে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দ্রুত দৌড়ে যেতে দেখলেন। হোজ্জা তাকে থামিয়ে বললেন, বৃষ্টি আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও আল্লাহর নিয়ামত। সেই নিয়ামত এভাবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
হোজ্জার কথা শুনে লোকটি লজ্জিত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে গন্তব্যে রওনা হলো। এর কয়েকদিন পর আবার বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি। এবার দৃশ্যপট উল্টো। লোকটি জানালা দিয়ে দেখল, হোজ্জা বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে দৌড়ে যাচ্ছে।
লোকটি হোজ্জাকে ডেকে বলল, আরে তুমিই তো সেদিন বললে, বৃষ্টি খোদার নিয়ামত। আজ সেই নিয়ামত ফেলে তুমিই পালিয়ে যাচ্ছ?
হোজ্জা কিন্তু লোকটির কথায় থামল না। বরং দৌড়াতে দৌড়াতেই বলল, হ্যাঁ, আমি এখনও তাই বলছি। খোদার সেই নিয়ামত কি পা দিয়ে মাড়ানো উচিত? এ জন্যই তো দ্রুত বাড়ি যাচ্ছি।

হোজ্জা সেদিন কত দ্রুত বাড়ি পৌঁছেছিলেন জানা না গেলেও এই নগরে আমরা যারা আছি তারা ঠিক জানি, বৃষ্টির কারণে জলজট, যানজটে আমাদের বাড়ি ফিরতে কতটা সময় লাগে। চোখের পানি নাকের পানিতে যেমন একাকার, সেদিন বৃষ্টির পানি আর ড্রেনের ময়লা একাকার। একেবারে হরিহর আত্মা। সেই আত্মাও আঁৎকে ওঠে জলাবদ্ধ রাস্তায় খোলা ম্যানহোলের কথা ভেবে। কত রিকশা যে সেদিন উল্টে যায়, কত আরোহী উল্টে পড়তে পড়তে মানসপটে কর্তৃপক্ষের গণেশ ওল্টানোর ছবি আঁকেন, কত সিএনজি রাস্তার কোমর পানিতে অসহায়ের মতো কোঁকায়, কত অলস সেদিন বিছানা থেকেই আর উঠে দাঁড়াতে চান না, কত ষোড়শীর কাকন পরা হাত সেদিন গ্রিলের ফাঁক গলে বৃষ্টির স্পর্শ নেয়, কত যুবকের মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা প্রেম বর্ষার পানি পাওয়া সতেজ পাতার মতো জেগে ওঠে বলা কঠিন।

এই যুবকের কথাই বলি- বেচারা প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে রেরিয়েছে। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের আলো ছড়াচ্ছে বিকেলের আকাশ। সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি। এমন রোমান্টিক পরিবেশ আর হয় না। হুড তোলা রিকশা টিনটিন বেলের শব্দে ছুটে চলেছে গন্তব্যহীন। হঠাৎ করেই রিকশাওয়ালা গতি কমিয়ে দিল। যুবক অবাক হয়ে বলল, মামা, এতো আস্তে চালাচ্ছেন কেন?
রিকশাওয়ালার খুব ইচ্ছে করছিল পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু সে পথের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল, আফা যে একটু আগে বলল, আস্তে... আস্তে...।

বৃষ্টি একেক জনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। কথায় আছে- কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। আসলে ওটা হওয়া উচিত- কারো আষাঢ় মাস কারো সর্বনাশ। কেননা এদেশে বেশি বেশি বৃষ্টি মানেই বন্যা। বন্যা মানেই দুর্গত এলাকায় ত্রাণ। আর ত্রাণ মানেই …। থাক ওসব কথা। ভোটের আগে যারা ভ্রাতা থাকেন তারা সকলে ত্রাতা হয়ে উঠুন শ্রাবণে এই প্রার্থনা। কিন্তু সোহান সাহেব এই কথাটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না, বর্ষা ঋতুতেই কেন রাস্তা খোঁড়াখুড়ির ধুম পড়ে যায়? ঘটা করে রাতদিন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ঘটরঘটর চলতেই থাকে। যেন সামনে বার্ষিক পরীক্ষা, সিলেবাস শেষ করতেই হবে। কিন্তু সিলেবাস আর শেষ হয় না। একপক্ষ শেষ করার পর হাজির অন্যপক্ষ। তাদের আয়োজন আরো ব্যাপক। তারা এসেই পুনরায় নতুন করে খুঁড়তে শুরু করেন। সেই খোঁড়াখুড়িতে রাজধানীর রাস্তাগুলো সত্যি সত্যি খোঁড়া রোগীর মতো বিছানায় পড়ে যায়। সেই রাস্তায় ভালো মানুষকেও চলতে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চার চাকাগুলো যে তার ওপর গড়গড় করে গড়িয়ে যাবে সে উপায় নেই। তারা চলে জিড়িয়ে জিড়িয়ে। মোদ্দাকথা মায়ের ভোগ, মানে ওই খিচুরি বৃষ্টির দিন সবার কপালে জুটুক আর না জুটুক, বৃষ্টিতে দুর্ভোগ মাস্ট। 

সোহান সাহেবের অফিস গুলশান। একদিন অফিসের কাজে তাকে মতিঝিল যেতে হলো। কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। অফিসের লিফটের সামনেই বসের সঙ্গে দেখা। তিনি কণ্ঠে মেঘের গুড়গুড় গর্জন তুলে বললেন, সকালে গেলেন সামান্য একটা কাজ নিয়ে এলেন এই সন্ধ্যায়?
সোহান সাহেব সোয়ান নন। চুলে, গালে, জামায় তখনও বৃষ্টির পানি লেপ্টে আছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, স্যার ওদিকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাটের যে অবস্থা! অসম্ভব কাদা-পানিতে একাকার। এক পা আগালে দুই পা পিছিয়ে আসতে হয়।
বস এবার কড়াৎককক করে উঠলেন। বাজ পড়া শব্দে বললেন, তাহলে সেখানে পৌঁছালেন কী করে?
সোহান সাহেবের একবার মনে হলো বলে দেন, উল্টো দিকে হেঁটে স্যার। কিন্তু তিনি তা বলতে পারলেন না। হেড হেট করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

বৃষ্টি কি বিষণ্নতা ছড়ায়? সেই অঝোর বিষণ্নতার মধ্যেও আনন্দে ভেসে ওঠে কত সুখস্মৃতি। মনে পড়ে ছেলেবেলা। ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’- কে কবে মেনেছে সে কথা? ফুটবল ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেও কৈশোরের দুরন্তপনা চুপসে যাওয়ার ছিল না কোনোকালেই- বাতাবি লেবুও তখন নিস্তার পেত না! তারপর ওই যে, বৃষ্টিভেজা ঘাসের ওপর চলার সময় স্যান্ডেল পিছলে কড়াৎ কড়াৎ শব্দ ওঠা।  সেই শব্দে ভয়কাতুরে ছোট্ট ব্যাঙের লাফিয়ে পালানো। টিনের চালে হুড়মুড় করে নেমে আসা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া। মনে ভয়মিশ্রিত বিস্ময়- ট্রেন যাচ্ছে নাকি চালের ওপর দিয়ে? কি গোলটাই না বাঁধত! তবুও উচ্চস্বরে ছড়া কাটতাম- আয় বৃষ্টি ঝেঁপে…।

শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও প্রিয় ছিল বর্ষা। একবার তিনি বাসন্তী রঙের সিল্কের জোব্বা পরে বসে আছেন। তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে রানী চন্দ এই অপরূপ সাজের কারণ জানতে চাইলেন। গুরুদেব বললেন, আমি যদি বসন্তকে আহ্বান না করি তো কে করবে বল। বসন্তকে তাই আহ্বান করছি। আমাকেই সবাইকে ডেকে আনতে হয়। এই দেখ না, বর্ষাকে ডাকি, তবে সে আসে। আবার থামাতেও হয় শেষে আমাকেই।
এমনও হয়েছে, তাঁর মালপত্র ট্রেনে উঠে গেছে অথচ আশ্রমে বসে বর্ষা উপভোগ করবেন বলে আকাশে মেঘ দেখেই গুরুদেব স্টেশন থেকে গাড়ি ঘুড়িয়ে কাউকে কিছু না বলেই আশ্রমে ফিরে এসেছেন।

সৃষ্টিশীল মানুষের এ হলো মনের খেয়াল। এ কালের হুমায়ূন আহমেদও কম খেয়ালী ছিলেন না। তার বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নাপ্রীতির কথা সকলেই জানেন। হুমায়ূন আহমেদের হঠাৎ শখ হলো ঝুম বৃষ্টিতে সমুদ্রের পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকবেন। শখ পূরণে তিনি কক্সবাজার চলে এলেন। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি সমুদ্রে গলাপানিতে বসে আছেন। ঢেউ এসে মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে-এ এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, হুমায়ূন আহমেদ সাগরে নেমেছিলেন সকাল দশটায়। সাগর থেকে উঠলেন সন্ধ্যার পর। শখ বলে কথা!

লেখাটি শুরু করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে দিয়ে, তাকে দিয়ে শেষ করলে ভালো হতো। কিন্তু এই কৌতুকটি বলার লোভ সামলাতে পারছি না। গ্রামের চৌচালা ঘর। বন্ধুরা মিলে তাস খেলছে। একজন উঠে বলল, এক মিনিট, ছোট কাজটি সেরে আসি।
সে ফিরে এলে দেখা গেল, তার জামা প্যান্টে পানির ছাট লেগে আছে।
সবাই  কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, কিরে! বাইরে বৃষ্টি হয় নাকি?
ছেলেটি বলল, না, তবে প্রচণ্ড বাতাস।

প্রচণ্ড বাতাসের চেয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি ভালো। কেননা আর যাই হোক, কালবৈশাখিতে বাঙালির হেঁসেলে খিচুরি রান্না হয় না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়