ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চে-ফিদেলের বিপ্লব ও বন্ধুত্ব

মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ৯ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চে-ফিদেলের বিপ্লব ও বন্ধুত্ব

মিলন আশরাফ : একজনের বয়স ৪০। অন্যজনের ২৮। বয়সের ব্যবধান চোখে পড়ার মতো। বয়সের বিচারে অসম বন্ধুত্ব। একজন আইন শাস্ত্রে পড়ার সময় চলে এসেছিলেন রাজনীতিতে। অন্যজন মধ্যবিত্ত ঘরের মেধাবী চিকিৎসক। বৈষয়িক হিসেবে এই পেশা লোভনীয়। কিন্তু সেই জীবনের লোভ ছেড়ে তিনি বেছে নিলেন গেরিলা জীবন। মার্কস-এঙ্গেলসের বন্ধুত্বের কথা আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আরো যাদের নাম আসে তারা হলেন ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা।

তাদের দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে, একেবারে যাকে বলে বন্দুক কাঁধে। সালটা ছিল ১৯৫৩। বাতিস্তার স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রথমবার ব্যর্থ হন ফিদেল। বন্দি হন তিনি। এরপর জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা চলে যান মেক্সিকো। ঠিক একই সময় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় নিজের অবস্থান পোক্ত করে সংগ্রামী জীবনে নিয়োজিত হন চে। সেখানেই দেখা হয় ইতিহাসের দুই মহানায়কের। আদর্শে মিল থাকায় গভীর বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। বন্ধুত্বের এই রূপরেখা ধরে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্বৈরাচারী সরকারকে উপড়ে ফেলতে হবে। আদর্শের চর্চা ও মিলিটারি ট্রেনিং দুজনকে আরও কাছে নিয়ে এসেছিল। বিপ্লবী দলে ফিদেলের পরের স্থানই চে’র। যাকে বলে সেকেন্ড ইন কমান্ড। দুজনই কাঁধে কাঁধ মিলে স্বৈরাচারী সরকারকে উপড়ে ফেলবেন এমন প্রতিজ্ঞা করেন। ৮২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের গেরিলা যুদ্ধ। এই যুদ্ধজয় তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করল। বিপ্লবের পর নতুন সরকার গঠিত হলো কিউবায়। প্রধানমন্ত্রী হলেন স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো। আর চে পেলেন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জমি বন্টন, শিল্পের বিষয়, জনশিক্ষা, সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ, জাতীয় ব্যাংকের কাজকর্ম, যুদ্ধবন্দীদের বিচারসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভার পড়ে চে’র ঘাড়ে।

১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত এই দুজনের বন্ধুত্ব ছিল মানিকজোড়ের মতো। কিন্তু ১৯৬৫ সালে এসে বলিভিয়ার মুক্তির লড়াইয়ে যোগ দিতে চে সবকিছু ছাড়লেন। যাবার বেলায় যে কথাগুলো বলেছিলেন তা আজও স্বর্ণের অক্ষরে খোদিত আছে। তিনি জানালেন, ‘ছেড়ে যাচ্ছি কিউবা। আমার ভূমিকা আসলে প্রশাসকের নয়, বিপ্লবের। মানুষের মুক্তির লড়াই, বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র আমাকে ডাকছে বারবার, আমি চললাম বলিভিয়া’। বলিভিয়ার ভয়ংকর জঙ্গল থেকে ১৯৬৫ সালের ১ এপ্রিল ফিদেলকে নিয়ে চে লিখেছিলেন: ‘আমার মৃত্যুটা যদি অন্য কোনো দেশে হয়, তা হলেও আমার কিউবার মানুষদের জন্য শেষ চিন্তাটি থাকবে, বিশেষ করে তোমাকে নিয়ে।’ সেই চিঠিতে ফিদেলকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে তিনি লেখেন: ‘আজ আমার তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই। সেই যে মারিয়া আন্তোনিয়ার বাড়িতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো। তুমি বললে, এসো একসঙ্গে লড়ি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ি। আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে হাত। তারপর থেকেই তো আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা গভীর হলো। আমরা যেন পরস্পরের পরম আত্মীয় হয়ে গেলাম। তখন আমাদের কোনো না কোনো কমরেডকে প্রায় প্রতিদিনই যেতে হচ্ছে লাস্ট ফ্রন্টিয়ারে। কে একজন যেন এসে বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে কাকে বেছে নেওয়া হবে, সেই বলির জন্য? আমি নিজ থেকেই বলেছিলাম, আমার নামটাই লিখতে। আমি চেয়েছিলাম তুমি থাকো। এখন আমরা পরিণত হবার কারণে আবেগটা হয়তো একটু কমে গেছে। কিন্তু আবার সেই একই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি, নিজের ভূখণ্ড কিউবার বিপ্লবে আমার যতটুকু করার, আমি করেছি। এখন আমার তোমার থেকে বিদায় নেওয়ার পালা…’

বিশ্ববিপ্লব চে গুয়েভারাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল প্রতিনিয়ত। তাই তো তিনি কিউবার সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে চলে যান। কিন্তু যাবার বেলায় তার ও ফিদেলের মধ্যে যে বন্ধন সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অদৃশ্য এক বন্ধন আমাকে বেঁধে ফেলেছে। এটা কখনও ভাঙা যাবে না।’ ফিদেলকে নিয়ে তার মনে যে একটু ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার ঘটেছিল সেটিও তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় ভুলটা ছিল সিয়েরা মায়েস্ত্রার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ চলাকলীন সময়ে। ওই দিনগুলোতে তোমার ওপর আমি তেমন ভরসা ধরে রাখতে পারিনি। বুঝে উঠতে পারিনি নেতা ও বিপ্লব হিসেবে তোমার গুণাবলিগুলোও। গুরুতর কিছু ফাঁক ছিল এখানে আমার, আজ বলতে দ্বিধা নেই। তবে আমি সবসময় তোমাকে অনুসরণ করেছি। আর সেটার জন্য গর্ববোধ করি। আমি তোমার পথেরই পথিক ছিলাম।’

বন্ধুবৎসল চে ফিদেলকে নিয়ে কবিতাও রচনা করেন। কবিতাটির শিরোনাম ছিল ‘ফিদেলের জন্য গান’ সেখানে তিনি তুলে ধরেন তাঁদের মধ্যকার স্বপ্নের কথা। ‘তুমি বলেছিলে সূর্য উঠবে

 

চলো যাই

 

সেই সব অজানা পথ ধরে

মুক্ত করতে তোমার প্রিয়

কুমির-গড়ন সবুজ স্বদেশ....যদি লোহাও দাঁড়ায় মাঝে

কিউবার অশ্রু আবরণ

ঢাকা দেবে গেরিলার হাড় মাংস

আমেরিকার ইতিহাসের যাত্রায়

এর বেশি কিছু নয়...

(বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনূদিত)

চে-ফিদেলের বিপ্লবী জীবনের বন্ধুত্ব ও বিচ্ছেদের মধ্যেও সম্পর্ক ছিল চির অমলিন। চে’র লেখা একটি চিঠির কিছু লাইন এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তিনি ফিদেলকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন: ‘ইফ মাই ফাইনাল আওয়ার ফাইন্ডস মি আন্ডার আদার স্কাইজ, মাই লাস্ট থট উইল বি অব দিস পিপল অ্যান্ড এস্পেশ্যালি অব ইউ’। মার্কিন সেনাদের হাতে বলিভিয়ার জঙ্গলে ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর প্রাণ দেন চে গুয়েভারা। আর তার ৫০ বছরের মাথায় ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ সালে চলে গেলেন ফিদেল। অনেক আগেই কাস্ত্রোকে আজীবন অনুসরণ করার কথা বলেছিলেন চে। ফিদেলও ৫০ বছর পর বন্ধু চে’কে অনুসরণ করে, না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কর্মে বলে গেলেন বিপ্লব ও বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়