ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একচক্ষু হরিণীরা : চতুর্থ পর্ব

রাসেল রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ১১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একচক্ষু হরিণীরা : চতুর্থ পর্ব

একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি মাহমুদ আর চম্পাকে ডাকলেন। প্রথমে চম্পাকে ডাকলেন, মা, বসো তো।

চম্পা বসল।

তোমার নাম কী, বলো তো?

চম্পা অবাক হয়ে গেল। এই প্রশ্ন সে আশা করেনি। কিছুটা অবাক, কিছুটা করুণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল। মাহমুদ আলীও অবাক হয়েছে কম না। কপালের যুগল কুঞ্চিত ভ্রু তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। সুবিদ আলী সেসব ভ্রুক্ষেপ করলেন না।

নাম বলো, মা।

চম্পা।

না। তোমার নাম চম্পা না। আজ থেকে তোমার নাম পারুল। আমি দিলাম এই নাম। মনে থাকবে?

চম্পা মাথা নাড়ল, মনে থাকবে।

তাহলে এবার বলো তো, তোমার নাম কী?

পারুল।

বাহ! খুব ভালো।... মাহমুদ বল তো, পারুলের নাম তাহলে কী এখন থেকে?

প্রশ্নটাই অদ্ভুত ছিল। মাহমুদ আগেই অবাক হয়ে ছিল। এখন আর অবাক হওয়ার সুযোগ নেই। সে আমতা আমতা করে বলল, পারুল।

বাহ। ভালো, ভালো।

এখন থেকে ওরে পারুল ছাড়া ডাকবি না, ঠিক আছে?

মাহমুদ মাথা নাড়ল।

সেই থেকে চম্পা নামের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল। জন্ম নিল পারুল।

চম্পা জায়গা করে নিয়েছিল সুবিদ আলীর বাড়িতে, পারুলকে তিনি সংসারে জায়গা দিলেন। বড় হলেই মাহমুদ আলীর সাথে সুবিদ আলী তার বিয়ে দেবেন। অন্ধ ছেলেকে কে বিয়ে করবে নইলে?

পারুলকে তিনি স্কুলে ভর্তি করলেন। অন্তত ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ুক। ঘরের বউ শিক্ষিত হলে সন্তান মানুষ হয়। সুবিদ আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পারুলকে তিনি এমনভাবে বড় করবেন যেন সৃষ্টিকর্তার পরেই সে মাহমুদ আলীকে স্থান দেয়।

পাঁচ
আহিরের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে ক্রমশ, থার্মোমিটারে জ্বরগ্রস্ত পারদের মতন। শুধুই বন্ধুত্ব? জানি না। বাড়ির সাথে যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার বাবা আমাকে বলেছেন আমি যেন কোনোদিন বাড়ি না যাই। গত চার বছর মা কিংবা বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই আমার। মুনিয়াকেও এড়িয়ে চলি।

মুনিয়া আমার এককালের ছাত্রী। তার বাবা বড় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। আমার দেখা প্রথম ডুপ্লেক্স বাড়ি ছিল মুনিয়াদেরটাই। তাদের বাড়িতে অনেকগুলো খরগোশ আছে, সেগুলো সামনের খোলা লনে দৌড়ে বেড়ায়। মুনিয়ার বৃদ্ধ দাদু বিকেলে হুইল চেয়ারে বসে পোষা খরগোশগুলোকে গাজর খাওয়ান। বছর চারেক আগে মুনিয়াকে তিন দিনের জন্য পড়িয়েছিলাম আমি। তারপর টিউশনিটা চল যায়। আমার ধারণা, আমার সম্পর্কে মুনিয়া খারাপ কিছু বানিয়ে বলেছে তার মাকে। তারপর থেকে সে হঠাৎ হঠাৎ একেক নম্বর থেকে ফোন দেয়।

কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করছি, স্থায়ী কোনো চাকরি হচ্ছে না। দুইবেলা খাই, তাও ভরপেট না। এমন এক ভয়াবহ অস্থির অবস্থায় আহির আমার কাছে আশ্রয় হিসেবে আবির্ভূত হলো।

আমার সম্পাদনা সহকারীর চাকরিটা হয়নি। তবে আহিরের হয়েছে। ভাইভার মাস দুয়েক পরে ডেকেছিল তাকে। ওদের ফোন পেয়েই আহির আমায় ফোন দিল, আমার চাকরিটা হয়েছে কি না জানতে। আমি কিছু জানি না বলতে আহির বলল, আমি যেন পত্রিকা অফিসে একবার খোঁজ নেই। এমনও হতে পারে যে ওরা আমার নাম্বার হারিয়ে ফেলেছে।
শিশুসুলভ কথাবার্তা! এই চাকরির আগ্রহ আমি সত্যি হারিয়ে ফেলেছি। অন্য দুয়েক জায়গায় চাকরির কথাবার্তা চলছে।

আহিরের সাথে আমার সম্পর্কটা গাঢ়তর হলো। তাদের অফিসে একেকজন প্রুফ রিডারকে মাসে তিন শিফটে ডিউটি করতে হয়। আহির মেয়ে বলে তার শিফট সব সময়েই নটা-চারটা। ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচটা বাজে। অফিস থেকে বের হয়েই সে আমায় ফোন দেয়। আমার আবাস আগারগাঁয়ে, আহিরের অফিসের কাছাকাছি। সে ফোন দিলে চলে যাই। চা খেতে খেতে দুজনে আড্ডা দিই। স্টার সিনেপ্লেক্সে ভালো কোনো সিনেমা এলে দেখতে যাই। কখনো কখনো দুজন হাঁটতে হাঁটতে শ্যাওড়াপাড়া চলে যাই, আহিরের বাসা পর্যন্ত। আহির বাসায় ঢুকলে আমি আবার একা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি।

‘লাইফ অব পাই’ চলছে সিনেপ্লেক্সে। থ্রিডি মুভি। আগেও একবার এসেছিল এই মুভি। দেখব দেখব করে দেখা হয়নি আর। দুপুর বেলা আহিরের ফোন পেলাম, মুকুল, চলো ‘লাইফ অব পাই’ দেখে আসি। আজ ডে অফ। বিকেলের শো দেখব। আমি থ্রিডি মুভি দেখিনি আগে।

আমিও থ্রিডি মুভি দেখিনি আগে। এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। জোর করে প্রমাণ করার কিছু নেই যে থ্রিডি মুভির লোভে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠেছি। বিভিন্ন ছুতোয় আহিরের সাথে দেখা করতে ভালো লাগতে শুরু হয়েছে আমার। দেখা করিও। সেসব ছুঁতো যে খুব জোরালো হয়, তা নয় মোটেই। তবু আহির যে না বোঝার ভান করে আমায় আশকারা দেয়, তাতেই আমি ধন্য। সত্যি কথা হলো, আহিরের সঙ্গ আমি বার বার কামনা করছিলাম। তার সঙ্গ আমায় এমন অনুভূতি দেয় যেন আমার নিজস্ব একটা সাম্রাজ্য আছে, কল্পিত, আমি তার সম্রাট। আর আহির সম্রাজ্ঞী নয়, সে নিজেই সাম্রাজ্য।

আমার প্রতি আহিরের কী অনুভূতি, কখনো ক্লিয়ার হতে পারিনি। এমনিতে সে খুব গোছানো। চাপ নিতেও অভ্যস্ত। তিন জনের একটি সংসার এই শহরে একা টানছে। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করছে, সেই সাথে ছোট ভাইকে কলেজে পড়ানো। এসব কারণেই তার মুখভঙ্গিতে একটা ভারিক্কি ছাপ পড়ে থাকে। কিন্তু ওটা মুখোশ। আমার সামনে মাঝে মাঝে এই মুখোশ খুলে ফেলে সে। একদম কিশোরী হয়ে যায়। আর মুখোশহীন আহিরের প্রেমে পড়ে যাই আমি। পড়তেই থাকি। পুরনো মুখোশঅলা আহিরের জন্য আমার মায়া হয় ভীষণ। কিংবা করুণা।

সিনেমায় রোমশ বাঘটি যখন নিঃসঙ্গ ‘পাই’কে নৌকায় আক্রমণ করেছিল, আহির ভয় পেয়ে আমার হাত চেপে ধরে। পরক্ষণেই সরি বলে বিদ্যুৎচমকের মতো হাত সরিয়ে নেয়। ঐ একবারই। আবার পুরনো মুখোশ! ভারিক্কি মুখ। কপাল কুঁচকানো। জোড়-ভ্রু আরও নিকটে আসে।

সিনেমার একটি দৃশ্যে ‘পাই’ শুয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। তখন আহির দেখলাম থ্রিডি চশমা খুলে ফেলল। আমারটাও খুলে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আচ্ছা, প্রেমের কবিতা লেখো না তুমি?

আহিরের মুখ থেকে হালকা এলাচের গন্ধ ভেসে আসে। আমি তন্ময় হয়ে যাই। ঠিক মনে পড়ে না, কোনো প্রেমের কবিতা লিখেছি কি না। আবার এক মুহূর্ত মনে হয়, আমার সব কবিতাই প্রেমের। পরক্ষণেই ঘোর কেটে যায়। বলি, সিনেমা হলে এটা কীসব আলাপ! বাচ্চাদের মতো!

কানের আরও কাছে মুখ নিয়ে এলো আহির। আর একচুল এগোলেই কানের লতিতে তার ঠোঁট লেগে যাবে। নাকি জিভ! ফিসফিস করে তারপর আহির আবার বলে, একটা কবিতা শোনাও না। একটা মাত্র।

ধ্যাত! সিনেমা হলে কবিতা? সিনেমা দেখো চুপচাপ।

প্লিজ। একটা মাত্র। সিনেমা আরেকদিন দেখব আবার।

না।

কী না? সিনেমা দেখবে না আবার?

এখন কবিতা শোনাব না। বের হয়ে শোনাই?

না, প্লিজ। এখনই।

আহিরের মুখ থেকে মুখোশ খুলে যেতে থাকে, দেখতে পাই আমি। এই মুখটাকে আমি বারবার ভালোবেসে ফেলি। এই মুখটাকে আমি ভয় পাই। বুঝতে পারি, এই মুখভঙ্গিই আমায় হারিয়ে দেবে। কে না জানে, কখনও কখনও কারও কারও কাছে হেরে যেতেও আনন্দ। এই রমণীর কাছে তো লক্ষবার হারতেও আমার আপত্তি নেই। এখনো একশই মাত্র পূরণ হয়নি!

আমি যে বারবার হেরে যাই আহিরের কাছে, বলার অপেক্ষা রাখে না, তার আশি ভাগ অন্তত ইচ্ছাকৃত। এবারও হেরে যাব, নিশ্চিত। তাও আবার মৃদু প্রতিবাদ করি, আহির, বের হয়ে শোনাই?

আবারও ফিসফিসানি, না।

এবার আমি আহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে আসি। শোনাতে যেন ইচ্ছে করছে না এমন ভঙ্গিতে ফিসফিস করি, আচ্ছা, শোনো—

কিছুদিন ধরে ভেন্ট্রিলোকুইজম শিখছি মুখ নাড়াচ্ছি না, তবু এই যে শুনতে পাচ্ছ ভালোবাসার সমূহ আয়াত, ও আমার ভেতর থেকেই আসছে আর এই যে পামিং—গোপনে তালুতে সিগারেট, ঝকঝকে কয়েন আর গোলাপ ধরে রাখার বিদ্যা—পনেরোশ টাকায় শিখে নেবার পরে রাতদিন চর্চা ও পরিচর্যা করে যাচ্ছি...
একদিন সাক্ষাৎ তোমায় লুকিয়ে ফেলব হাতের তালুতে বসে কলহাস্যে মেরি-গো-রাউন্ড চড়বে, এই জামার দীর্ঘ আস্তিন নড়ে উঠবে পতাকার মতো—হাওয়ায় আমি ভালোবাসার কথা বলে যাব, তুমি উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়বে, চিৎ হয়ে ঘুমুবে...আর ওসব নোংরা মুখোশ তখন ছুড়ে দিও অনুসন্ধিৎসুদের উদ্দেশে


আহির আবার আমার দু হাত টেনে নেয় নিজের নম্র দুই হাতে। তারপর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করতল দেখে। যেন সত্যি সত্যি তাকে লুকিয়ে রেখেছি। ম্লান ভঙ্গিতে হাসে সে। কী যেন খোঁজে। পাগলের মতো। আচ্ছন্নের মতো। নিজেকেই?

ম্লান স্বরে তরল চোখ মেলে আহির বলে, আরেকটা।

আমি অবাক হয়ে বলি, আরেকটা কী?

আরেকটা শোনাও। প্রেমের কবিতা।

জোরে হাসতে গিয়েও আহিরের চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যাই আমি। তার মুখ সিরিয়াস। কেমন তৃষ্ণার্তও। মিনিটখানেক চোখ বন্ধ করে মনে করতে থাকি, কোনটা শোনানো যায়। কোনটা, কোনটা... গুছিয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করি পুনরায়—

বান্ধবীদের কেউ আমার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলেই বলি আমলাপাড়া এসে পরিত্যক্ত লাল টেলিফোন বুথটা খুঁজে নিবি ডান পাশের বাড়িটাই আমার

সোজা ঢুকে যাবি

বাড়ির কাছাকাছি এসে সবাই আগে লাল একটি টেলিফোন বুথ খোঁজে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি দেখি, একটি পরিত্যক্ত লাল টেলিফোন বুথ আমার দিকে তাকিয়ে আছে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে


দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে আহির। নাকি কয়েক বছর! তারপর হাত সরিয়ে নেয়। কিচ্ছু না বলে আবার থ্রিডি চশমা পরে চোখে। আলতো করে বাঁ হাতটি রাখে শুধু, আবার, আমার হাতে। তার মুখে আস্তে আস্তে গাঢ় হতে থাকে মুখোশ।

সিনেমা শেষ করে বের হলাম ছটায়। রাস্তায় খুব জ্যাম। দুজন হাঁটতে শুরু করি শ্যাওড়াপাড়ার দিকে। হঠাৎ আহিরের দিকে তাকিয়ে চমকে যাই আমি। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। আহিরের চোখ ভেজা। সে নীরবে কাঁদছে।

কিছুই বুঝতে পারলাম না। অজান্তে কি কোনো বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি? হায় খোদা!

আহিরকে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে আহির?

আহির মাথা নাড়ে, কিছু না।

তোমার চোখে পানি কেন? আমি কি খারাপ কিছু করেছি? কোনো অসভ্যতামি?

আহির চঞ্চল হয়ে জবাব দিল, না না! তা নয়। আমিই আজ তোমার সাথে বাড়াবাড়ি করেছি। সরি। বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু অমন মেয়ে নই।

আমি হেসে ফেলি।

আহির সিরিয়াস মুখ করে বলল, টেলিফোন বুথটার জন্য মায়া হচ্ছে। খুব। আমি নিজেও কি পুরনো টেলিফোন বুথ? লাল রঙের?

আমি আহিরের হাত চেপে ধরি। ছি ছি। তোমাকে অবহেলা করবে কে?

আহিরকে বাসায় দিয়ে আসার পর জ্বরে পড়ি। টানা তিনদিন শুধু তন্দ্রা আর জাগরণের মধ্যে কাটে। ঘোরের মধ্যে কয়েকবার মাকে দেখেছি। একবার বাবাও এসেছিলেন। অন্ধ বাবা আমার, হাতড়ে হাতড়ে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আহির এসেছিল একবারও? মনে নেই। তবে মুনিয়া এসেছিল একবার। আহ্লাদী ভঙ্গিতে বারবার বলছিল, স্যার, আমার সাথে কবে দেখা করবেন? একটু বাদে বাদেই সে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝুঁকে আসে মুখের সামনে। আমি তাকে বলি, তোমার জামার গলা সামনে থেকে বেশি ঢোলা। আর বার বার অমন ঝুঁকে এসো না সামনে। মুনিয়া আরও ঝুঁকে আসে। আমি বলি, কী বলেছিলে তোমার মাকে, সত্যি বলো তো? মুনিয়া আরও ঝুঁকে আসে। আমি বলি, তুমি কেন সব রেখে চোখের ডাক্তার হয়েছ, বলো তো? মুনিয়া আরও ঝুঁকে আসে...
পৃথিবীর সমস্ত সত্যিকারের শব্দ থেকে দূরে ছিলাম। শুধু থেকে থেকে মাথার ভিতর সেলফোনের রিংটোন শুনতাম। ফোন রিসিভ করার ইচ্ছে ছিল না, শক্তিও না।
আমার বাড়িতে আমি একলা থাকি, মরে গেলেও টের পেতে সপ্তাহখানেক লাগবে।


ছয়
বরং ফাঁকে চা-অলা কাকির গল্পটা বলে ফেলি। প্রেমঘটিত প্রথম বেদনা আমি অনুভব করেছিলাম একুশ বছর বয়সে। এটা সেই গল্পও।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে নেমেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সবকিছু পাল্টে গেছে। অবশ্য আশাও করিনি যে এক যুগ পরেও সব একই রকম থাকবে। তবে এতটা পাল্টাবে তাও কল্পনায় ছিল না।
ছোট্ট স্টেশনটি আয়তনে অনেক বেড়েছে- তা নয়, তবে সব জায়গায় দোকানপাট উঠে হুলুস্থুল অবস্থা। এখন আরও কেমন যেন ছোট লাগছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন স্টেশনটা কত বড় লাগত। স্টেশনের ওপাশে ছোট্ট একটা মাঠ ছিল, সে মাঠে বিকেল বেলা ছোট ছোট বাচ্চারা দাপাদাপি করত। সে মাঠ কোথায়! কোনো চিহ্নই নেই তার।
বারো বছর আগে শেষ দেখা স্টেশনটি আমার কাছে বড় বেশি ছোট আর নতুন লাগতে লাগল।
হ্যাঁ, একটা জিনিস এখনো আগের মতোই আছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। অবাক ব্যাপার, সেই আগের মতোই কেমন যেন অপরাধী কণ্ঠে সে যেন আমায় বলতে লাগল, কতদিন পর তুমি এলে! আমি জানতাম তুমি একদিন আসবে। আসবেই! দেখো, তুমি কত বড় হয়ে গেছ। তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য আমি আর বড় হইনি। যদি তুমি চিনতে না পার! আমি তোমায় ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছি।

স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম কৃষ্ণচূড়ার কণ্ঠ।
গাছভর্তি রক্তবর্ণের ফুল ফুটে আছে। পথেও ঝরে আছে অসংখ্য। সমস্ত পথ যেন রক্তাক্ত হয়ে আছে, পাপড়িগুচ্ছ ছড়িয়ে আছে এমন ভঙ্গিতে। আমি আলতো ভাবে পা রাখলাম রাস্তায়। বিড়বিড় করে বললাম, তোমাকে কি আমি ভুলতে পারি? সম্ভব?

বারো বছর আগের এক শীতকালীন ভোরবেলা উঁকি মারে আমার মনে, যে ভোরে মা মৃদু ঠেলা দিয়ে উঠিয়েছিলেন আমায়, মুকুল, মুকুল, ওঠ। ওঠ বাবা।
ধড়মড় করে জেগে উঠি। মায়ের মুখ দেখে ঘুম দৌড়ে পালায়। তবে কি আজকেই সেই দিন? মা কয়েকদিন আগে আমায় বলেছিলেন, আমরা এখান থেকে চলে যাব, বুঝলি! কাউকে কিছু বলবি না, বুঝলি!
মি মাথা নেড়েছিলাম। সেই বয়সে বুঝতে পারিনি, এমন অবস্থায় আছি, আমার মা বেচারি কারও সাথে বিষয়টা শেয়ারও করতে পারছেন না। শেষে আমাকে বলে কিছুটা হালকা হয়তো হয়েছিলেন।
ভোররাতে মায়ের ফিসফিস ডাকে বুঝে গিয়েছিলাম, কিছু একটা হয়েছে। কোনো শব্দ করা যাবে না। শব্দ করলেই বিপদ। কোনো শব্দ করিনি। অথচ তখন প্রস্রাবে আমার তলপেটে প্রচণ্ড চাপ। একটু পরে ভয়াবহ ব্যথা শুরু হলো। মাকে কিচ্ছু বলিনি। এমনকি নিজেও যে হাফপ্যান্টের জিপার খুলে প্রস্রাব করব, সেই সাহসটুকু জড়ো করতে পারিনি। মায়ের মুখই বলে দিচ্ছিল, সামান্য দেরি করলেই বিপদ। বাবার মুখ ছিল সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন। সামান্য ত্রস্ত একটা ভাব।

মায়ের হাত ধরে সেই ভোরে আমি আর আমার অন্ধ বাবা এই স্টেশনের একটা ট্রেনে উঠেছিলাম গুটি গুটি পায়ে, যেন একটা আঙুল রাখার শব্দও কেউ শুনতে না পায়। কেউ আমাকে কিছু বলে দেয়নি- তবু বুঝতে পারছিলাম, বাবা-মা এই ছোট্ট মফস্বল শহরটি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছিলাম, আর কোনোদিন হয়তো এ শহরের সাথে আমার দেখা হবে না।
মায়ের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছিল। বাবারও। দুজনেই কাঁপছেন। মায়ের এবং বাবার সেই করুণ মুখ কোনোদিন ভুলতে পারব না আমি। কোনোদিন না!
যখন ট্রেন ছাড়ল তখন আম্মার এক হাত শক্ত করে ধরে আছেন আব্বা, অন্য হাত আমি। আমার তলপেট তখন ফেটে যাচ্ছে। (চলবে)



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়