ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বানভাসি মানুষের ঈদ

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৬, ২১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বানভাসি মানুষের ঈদ

সাইফ বরকতুল্লাহ : খবরটা পড়েই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এরপর সারাদিন কোনো কাজে মন বসেনি। বাড়িতে কয়েকবার ফোনে কথা হলো বন্যা পরিস্থিতি জানতে। কারণ ওই খবরটাই যে হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

গণমাধ্যমর প্রকাশিত খবরটি এরকম-‌ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর এলাকায় হাশেম আলী। এখানে তার বসতি প্রায় তিন যুগ ধরে। বছর তিনেক ধরে উত্তাল পদ্মার আগ্রাসী ভাঙন সেই গ্রামের দুই শতাধিক বাড়ি, বাজার ও রাস্তা শেষ করে দিয়েছে। এখন তার বাড়ির পাশে এসে উঁকি দিচ্ছে পদ্মার ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের জল। আট বছর আগে মা ফুলবুরু বেওয়া মারা যাওয়ার পর তার কবর দেওয়া হয়েছিল বসতভিটার পাশে। এখন মায়ের কবরের দোরগোড়ায় আগ্রাসী পদ্মা। নিজের পরিবার ও ঘরবাড়ি সরিয়ে নিলেও নিতে পারছেন না মায়ের কবরটি। মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা সেই কবরটি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে, চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে বিষাদে ভরে উঠছে বুকটা। কবরের পাশেই সারাটি দিন কেঁদে পার করেন হাশেম আলী ও তার ছোট মেয়ে রওশনা আক্তার। পাশেই চলছে ঘরবাড়ি ভাঙাচুরার খেলা। গত শুক্রবার দুপুরে পদ্মার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সজোরে, পাকা কবরের অর্ধেক অংশ ঝুলে আছে নদীতে। একেকটি ঢেউ যেন আঘাত হানছে হাশেম আলীর অন্তরে। এরপর হঠাৎ দৌড়ে গেলেন তার মায়ের কবরের পাশে। শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখলেন। মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল কবরটি পদ্মার অতল গহ্বরে। সেই সাথে চিরতরে হারিয়ে গেল হাশেম আলীর সবচেয়ে আপন মমতাময়ী মায়ের শেষ স্মৃতিটুকু। বিলাপ করতে লাগলেন, একটু আগে এইখানে ছিল মায়ের কবর; পদ্মার ফেনিল ঢেউয়ের পানে ইশারা করে অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, আমার সব শেষ হইয়া গেল রে, সব গেল। পাশ থেকে তার স্ত্রী রাশিদা বেগম বলেন, ‘এই গ্রাম ভাঙব কহনও ভাবতে পারি নাই, এই গ্রামের আগে আরেক গ্রাম আছিল, তা ভাইঙা গেছে। কম কইরা হইলেও এক শ’ পরিবার গ্যাছে। এইব্যার ভাঙন আরো বেশি মনে হইত্যাছে। অনেক বাড়িঘর চইল্যা গেছে নদীতে।

প্রিয় পাঠক, বলছিলাম হাশেম আলীর গল্প।  শুধু হাশেম আলীই নয়, দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এসব এলাকায় এখন বানভাসি মানুষ খুবই কষ্টে দিনযাপন করছে। ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। ক্ষেতের ফসল পানির নিচে। ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। রোববার পর্যন্ত সবশেষ খবর অনুযায়ি বন্যায় এরই মধ্যে প্রায় একশ জনের প্রাণ গেছে। ১০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিধ্বস্ত হওয়া সড়কপথের দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৮০০ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সরাসরি আক্রান্ত এলাকার লাখ লাখ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বন্যাকবলিত ২৭ জেলায় ছয় লাখ ১৮ হাজার ৭০৯ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দুই.

 

আর কয়েকদিন পরেই ঈদুল আজহা। অনেকের বাড়িতেই ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। অনেকেই কোরবানির জন্য গরু কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু বন্যায় আক্রান্ত বানভাসি মানুষগুলো এখন কাঁদছে। তারা দিশেহারা। কেমন করে কাটবে তাদের কোরবানি ঈদ?  কেমন করে বাঁচবে ওরা?  কবে পানি সরে যাবে? কবে আবার নতুন করে ধান চাষ করবে?  কীভাবে হবে বানভাসি মানুষের কোরবানি ঈদের আনন্দ?  এসব চিন্তাই বা করার সময় কই? সত্যিই এক ব্যাথাতুর সময়।

তিন.

 

আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ইভেন্ট খোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম সফর করে নিজে ত্রাণ বিতরণ করেছেন।তারপরও আরো প্রয়োজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এখন পর্যন্ত যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। বন্যার সময় শুধু নয়, পানি নেমে যাওয়ার পর আরেক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। রোগবালাই দেখা দেয়। বন্যায় ঘরবাড়ি ও ফসল হারানো মানুষদের  পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, তার পরিকল্পনাও এখনই গ্রহণ করতে হবে। নিতে হবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, ঈদের দিন বন্যাদুর্গত মানুষরা যেন কোরবানির মাংস পায় সেজন্য যারা কোরবানি দিবেন এ বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে তাদের। অর্থাৎ এখন বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো সবচেয়ে জরুরি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়