ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বিসমিল্লাহ খাঁ : বহু সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিসমিল্লাহ খাঁ : বহু সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক

রুহুল আমিন : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় সানাই সম্রাট ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁর ১২তম প্রয়াণ দিবস আজ । তিনি ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে  ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসির হেরিটেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

বিসমিল্লাহ খাঁর জন্ম ১৯১৬ সালে ২১ মার্চ বিহারের দুমরাও অঞ্চলের এক সংগীত পরিবারে । কথিত আছে, জন্মের সংবাদ শুনে তার দাদা বিসমিল্লা বলে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার পর থেকেই এটিই তার নামে পরিণত হয়। পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবেই তিনি সানাই বাজানোর চেষ্টা করতেন। তার চাচা রসুল বক্স খাঁ ভোজপুর রাজ দরবারের সানাই বাদক ছিলেন।

বিসমিল্লাহ খাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে উত্তর প্রদেশের বারানসিতে। এখানেই তার সানাইয়ে হাতেখড়ি। গঙ্গার তীর ও বালাজি মন্দিরসহ আশপাশের মন্দিরগুলোতে সানাই বাজাতে বাজাতে বেড়ে ওঠেন তিনি।

বিসমিল্লাহ খাঁর বাবার নাম পয়গম্বর বক্স। মামারবাড়ি বারনসিতে। তার পিতামহ, পিতা ও তিন মামা আলী বক্স, বেলায়েত হোসেন ও সাদেক আলী প্রত্যেকেই সানাই বাদক ছিলেন। সাত বছর বয়সে লেখাপড়া শেখার জন্য বিসমিল্লাহ খাঁ মামারবাড়ি বারানসিতে চলে আসেন। তার বাবা বিসমিল্লাহকে উচ্চশিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন,  কিন্তু বিসমিল্লাহ খাঁ সংগীতের প্রতি ভীষণ রকম অনুরক্ত হয়ে ওঠেন।ফলে লেখাপড়া আর হয়নি তার।

মামা আলী বক্সের কাছে বিসমিল্লাহর সংগীতে হাতেখড়ি। প্রথম তিনি মামার সঙ্গে তবলা সংগীত করতেন। এভাবে তাল লয়ে পাকা হয়ে উঠতে থাকেন। এরপর শুরু হলো সানাইয়ে তালিম। বারানসির সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ হোসেন খাঁর কাছে গানের তালিমও নিতে থাকেন। এভাবে খুব অল্প বয়সেই ঠুমরি, কাজরি ও সাওয়ানিসহ সংগীতের বেশ কিছু ধারা আয়ত্ত করে ফেলেন। পরে উচ্চাঙ্গ সংগীতের একটি ধারা খেয়ালের ওপর পড়াশোনা করেন। এ সময় কিছু জটিল ও মোহনীয় সুর আবিষ্কার করেন তিনি। তার নতুন ও ভিন্ন ধাচের এ সুর শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সর্বত্র সাড়া ফেলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিসমিল্লাহ খাঁ তার ওস্তাদ ফাইয়াজ খাঁর সঙ্গে এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে অংশ নেন। প্রথম সুযোগেই বাজিমাত করেন তিনি ।

১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মিউজিক কনফারেন্সে তিনি সানাইকে সংগীতের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এরপর ১৯৩৮ সালে লখনৌতে সর্বভারতীয় বেতারের উদ্বোধন তাকে আরেকটি বড় সুযোগ এনে দেয়। ওই বছর থেকে বেতারে প্রায়ই তার সানাইয়ের সুর শোনা যেত। বিসমিল্লাহ খাঁর জীবনে এর পরবর্তী অধ্যায় সাফল্য, যশ আর খ্যাতির ইতিহাসে ভরপুর।

ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন বিসমিল্লাহ খাঁ। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন রিকশা বা সাইকেলে চড়তে। তার সানাইয়ের সুর হিন্দু, মুসলমানদের এক কাতারে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আমৃত্যু তিনি বারানসির গঙ্গার তীরে নিভৃত পল্লীতে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়েই থেকেছেন। একজন ধর্মপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়েও হিন্দুদের মন্দিরে মন্দিরে সানাই বাজিয়েছেন। এক সময় বিশ্বনাথ মন্দিরে প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু হতো বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই দিয়ে। এ জন্যই ভারতে তাকে বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতা ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় ।

তিনি বিশ্বাস করতেন কাজে অর্থাৎ তার শিল্পসম্ভার মানুষকে দেওয়াই তার কাজ। লোক দেখানোর কিছু নেই। তবে মেজাজি মানুষ ছিলেন। সব কিছু তার পছন্দমতো ঠিকঠাক হলেই তিনি জাদুকরী সানাই বাজাতে শুরু করতেন। তার মনমতো না হলে মাইক্রোফোন ছুঁড়ে ফেলে দিতেন।

বিসমিল্লাহ খাঁ ১৯৫৯ সালে মাত্র একটি হিন্দি ছবিতে সানাই বাজিয়েছিলেন। ওই ছায়াছবির নাম ছিল ‘গুঞ্জ উঠি সেহনাই’ অর্থাৎ সানাইয়ের প্রতিধ্বনি। একবার এক সংগীত পরিচালক তার সানাই বাদনের সময় হস্তক্ষেপ করেন। পরিচালক তার নির্দেশিত ধারায় বাজাতে বললে তিনি ক্ষুব্ধ হন। সেই থেকে তিনি আর কখনও বলিউডমুখী হননি।

বিসমিল্লাহ খাঁ কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। মোহাম্মদ হোসেন খাঁর তালিমে তিনি কণ্ঠসংগীতেও বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। বিশেষ করে ভজন গান। তিনি অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠে ভজন গাইতে পারতেন। তার সেসব গান ভক্তিরসে পরিপূর্ণ ছিল।

বিসমিল্লাহ খাঁ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর আমন্ত্রণে সানাই বাজিয়েছিলেন ঐতিহাসিক নিদর্শন লালকেল্লায়। সানাই শুনিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের মোহিত করে ফেলেছিলেন। তখনও অবশ্যই তিনি সানাই সম্রাট হননি। পরবর্তী জীবনে শুধু ভারতবাসীকে নয়, তার সুরের মায়াজালে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে মোহিত করেন।

মহান এই সংগীতজ্ঞের একক প্রচেষ্টায় বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় সানাই। দীর্ঘ সংগীত জীবনে বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাজধানীতে সানাই বাজিয়েছেন। প্রথম সফর বাদশাহ জহির শাহের আমলে আফগানিস্তানে। তারপর একে একে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইরাক, ইরান, কানাডা, আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, হংকংসহ বিশ্বের নানা স্থানে, নানা প্রান্তে তিনি সানাই বাজিয়েছেন। ২০০০ সালে ঢাকাতেও অনুষ্ঠান করেছেন তিনি।

বিসমিল্লাহ খাঁ তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাকে ১৯৬১ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৮০ সালে পদ্মা বিভূষণে ভূষিত করে। সর্বশেষ ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারতরত্নে ভূষিত হয়েছেন ২০০১ সালে। ১৯৯৪ সালে তিনি রাজীব গান্ধী সম্মাননা পান। বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটি ও বিশ্বভারতী তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া তিনি পেয়েছেন সংগীত-নাটক একাডেমি পুরস্কার ও মধ্য প্রদেশ সরকারের তানসেন পুরস্কার। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। গৌতম ঘোষ তার জীবনভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়