ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আকবরনামা’র আবুল ফজল

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আকবরনামা’র আবুল ফজল

শেখ আবুল ফজল

শাহ মতিন টিপু : মুঘল সম্রাট আকবর বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনে একটি কারণে চিরঞ্জীব থাকবেন, আর তা হচ্ছে বাংলা সন। আকবরকে যারা জানেন তারা আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজলকে জানেন।

সম্রাটের আদেশে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজী বাংলা সনের পঞ্জিকা তৈরি করলেও আবুল ফজল এতে আস্টেপৃষ্ঠেই জড়িয়ে ছিলেন। কারণ, অসাধারণ মেধাবী ছিলেন এই আবুল ফজল। ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। একাধারে রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, লেখক, অনুবাদক ও কবি। আর এই সবগুলো গুণেই আলাদা খ্যাতিসম্পন্ন তিনি। সম্রাট আকবরের রাজকার্যে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে স্বীকৃত হতো। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুও ।

সম্রাট আকবরের শাসনামলে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষি ও ভূমি কর বা খাজনা আদায় হতো হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাতেও তাই। অথচ কৃষিকাজ সম্পাদিত হয় সৌরবর্ষ তথা সৌরমাসের হিসেবে। কিন্তু হিজরী সন নির্ভরশীল হলো চাঁদের উপর, সঙ্গত কারণেই কর আদায় আর কৃষি ফলনের সময় সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছিল না। আবুল ফজল সম্রাটকে এই বাস্তবতা বোঝালেন। সম্রাট আকবর বিষয়টি অনুধাবন করে প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। সেই সূত্র ধরেই প্রবর্তন হয় বাংলা সনের ।

দুর্ভাগ্যের বিষয় আবুল ফজলের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি খুন হয়েছিলেন। তাও আবার যুবরাজ জাহাঙ্গীরের নির্দেশে। আর যে অভিযোগে খুন হয়েছিলেন, তারজন্য মোটেই দায়ী ছিলেন না মহাজ্ঞাণী আবুল ফজল। হয়তোবা এটাই ছিল তার নিয়তি বা ভবিতব্য। অনেক আলোচক-সমালোচক এমনটাই মনে করেন।আবুল ফজল খুন হওয়ার সে দিনটি ছিল ২২ আগস্ট।

১৬০২ সালের ২২ আগস্ট যুবরাজ জাহাঙ্গীরের বিশ্বস্ত সেনাপতি বীর সিংহ বুন্দেলা আবুল ফজলকে খুন করেন। তিনি তখন দাক্ষিণাত্য থেকে রাজধানীতে ফিরছিলেন। মৃত্যুর আগে আবুল ফজল বলে যান যে, তিনি নির্দোষ। ইলিয়াস খানই আনারকলিকে সম্রাট আকবরের বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন।

আসলে যুবরাজ জাহাঙ্গীর প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতেন আবুল ফজলকে। মহলের নর্তকী আনারকলিকে নিয়েই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি এবং আবুল ফজলের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন যুবরাজ জাহাঙ্গীর ।

যদিও এস ওয়াজেদ আলী তার ‘ধর্ম ও সমাজ’বইতে লিখেন, ‘আবুল ফজল দীনে এলাহির মন্ত্র বাদশাকে শিখিয়ে ছিলেন বলে বাদশার জীবদ্দশাতেই শাহজাদা সেলিম (এই সেলিমই পরে জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করেন)  তার শিরশ্ছেদ করেন এবং সেই মূল্যবান মস্তকটি পায়খানার গর্তে নিক্ষেপ করেন। আকবরের মৃত্যুর পর দীনে এলাহির নাম আর ভারতবর্ষে শোনা যায় না।’ (ধর্ম ও সমাজ-পৃঃ ৫৪, নবযুগ সংস্করণ-২০১২) পুরো নাম শেখ আবুল ফজল আল্লামি। আবুল ফজলের জন্ম ১৫৫১ সালের ১৪ জানুয়ারি আগ্রায় । শৈশব ও কৈশোরেই তার অসাধারণ পান্ডিত্যের খবর ছড়িয়ে পড়ে। স্বয়ং সম্রাট আকবর তার বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেন আবুল ফজলের দিকে। ফলে ১৫৭৫ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল রাজদরবারে যোগদান করেন সরাসরি মন্ত্রী হিসেবে। তখন তার বয়স মাত্র ২৪ বছর।

আবুল ফজল ছিলেন অসাধারণ সহজাত মেধার অধিকারী, অল্প বয়সেই তিনি বয়সের তুলনায় অধিক বোধশক্তির পরিচয় দেন। তার পিতা ছিলেন সে যুগের সবচেয়ে কৃতী বিদ্বানদের অন্যতম। শেখ মোবারক ছিলেন শেখ আবুল ফজলের বাবা। তার পিতার কাছেই আবুল ফজল শিক্ষালাভ করেন।

আবুল ফজলের ধর্ম ছিল মানবতা। হিন্দু, মুসলমান, পারসি, খ্রিস্টান সকলেই তার কাছে সমান ছিল। তার উদার চিন্তাভাবনা, সমাজভাবনা ও ধর্মচিন্তা বিচার করে তাকে চিরায়ত আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী বলা যায়। আবুল ফজল যদি  কেবল নিজের লিখনী চালিয়েও যেতেন, তবুও তিনি একজন অমর সাহিত্যিক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। ‘আকবরনামা’ ও  ‘আইন-ই-আকবরী’তার বিস্ময়কর অবিস্মরণীয় বই।

আবুল ফজল আল্লামীর অমর সৃষ্টি ‘আকবরনামা’। ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জি সম্বলিত এই ফার্সি গ্রন্থটি ভারত উপমহাদেশে ইতিহাস সম্পর্কিত রচনার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সর্বোত্তম বলে গণ্য। আকবরনামা তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে রয়েছে তিমুর বংশের ইতিহাস, বাবর ও হুমায়ুনের রাজত্বকাল এবং দিল্লির শূর বংশের সুলতানদের বিবরণ; দ্বিতীয় খন্ডে আকবরের রাজত্বের ছেচল্লিশতম বছর পর্যন্ত ঘটনাবলির বিস্তৃত বিবরণ এবং তৃতীয় খন্ডে আকবরের সাম্রাজ্যে প্রচলিত বিধিবিধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি বর্ণিত আছে। এ শেষ খন্ডের নাম আইন-ই-আকবরী।

আকবরনামায় মুঘলদের বংশ পরিচয়, রাজ্য শাসন, বিচার ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, বণ্টন, সামরিক বিষয়াদি, যুদ্ধযাত্রা, যুদ্ধ জয়, কূটনৈতিক নানা বিষয় এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে সম্রাট আকবর যেন জীবন্ত হয়ে আছেন।

বলা হয়, আবুল ফজল আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম চিন্তাবিদ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়