ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভাটির বাউল শাহ আব্দুল করিম

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাটির বাউল শাহ আব্দুল করিম

রুহুল আমিন : শাহ আব্দুল করিম। জন্ম সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে। বাংলা বাউলগানের জগতে একজন কিংবদন্তি শিল্পী। ২০০৯ সালের আজকের এই দিনে (১২ সেপ্টেম্বর) তিনি প্রয়াত হন।

দরিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। তার প্রেরণা তার স্ত্রী। যাকে তিনি আদর করে ‘সরলা’ নামে ডাকতেন। তার জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে । বাবার নাম ইব্রাহীম আলী ও মায়ের নাম নাইওরজান।

১৯৫৭ সাল থেকে শাহ আব্দুল করিম তার জন্মগ্রামের পাশের উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বেড়ে ওঠা শাহ আব্দুল করিমের গান ভাটি অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ।প্রায় দেড় হাজার গানের স্রষ্টা তিনি।

ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে।

দরিদ্রতার কারণে ছেলেবেলায় কৃষিকাজ করতেন। কিন্তু গান সৃষ্টি থেকে বিরত থাকেননি কখনো। তিনি বাউলগানের দীক্ষা লাভ করেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরিয়তি, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।

স্বশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিমের ১০টি গান বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকজন মূল ধারার শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।

বাউলসাধক শাহ আব্দুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন চরম দরিদ্রতার সঙ্গে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা তিনি কখনোই গ্রহণ করেননি।

শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় কিছু গান হলো- ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না’, ‘ ঝিলঝিল ঝিলঝিল করেরে ময়ুরপংখী নাও’,  ‘মানুষ হয়ে তালাশ করলে’,  ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’  ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’,  ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’,  ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’,  ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’,   ‘আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু’,  ‘সখী কুঞ্জ সাজাও গো’ ইত্যাদি।

এ ছাড়া এই পর্যন্ত শাহ আব্দুল করিমের সাতটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো-আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮),  গণসঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে (২০০১) ও শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯)।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তার রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আব্দুল করিম স্মারকগ্রন্থ (অন্বেষা প্রকাশন) তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।

এর আগে-পরে শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে সুমনকুমার দাশের ‘বাংলা মায়ের ছেলে : শাহ আব্দুল করিম জীবনী’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘সাক্ষাৎকথায় শাহ আব্দুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘শাহ আব্দুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম’ (উৎস প্রকাশন), ‘গণগীতিকার শাহ আব্দুল করিম’ (উৎস প্রকাশন) প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয় সুমনকুমার দশের ‘শাহ আব্দুল করিম : জীবন ও গান’ বইটি। এ বইটি ইতোমধ্যেই একটি প্রামাণ্য জীবনী হিসেবে বোদ্ধামহলে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে।

শাহ আব্দুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। পেয়েছেন কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার,  লেবাক এ্যাওয়ার্ড, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা,  খান বাহাদুর এহিয়া পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা, হাতিল এ্যাওয়ার্ড ও এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা।

এ ছাড়া শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘ভাটির পুরুষ’ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। সুবচন নাট্য সংসদ তাকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের ৮৮টি প্রদর্শনী করেছে।
শাহ আব্দুল করিমকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়