ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বাংলার গানে যার নামেই বসন্ত

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলার গানে যার নামেই বসন্ত

রুহুল আমিন : ওপার বাংলার জীবনবাদী গায়ক নচিকেতা তার এক গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে এভাবেই তুলে আনেন, ‘বাংলার গানে যার নামেই বসন্ত/তিনিই গায়ক-সুরকার হেমন্ত’। 

শুধু বাংলা কেন, হিন্দি গানের দর্শক-শ্রোতার কাছেও সমান জনপ্রিয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিশেষ করে তার রোমান্টিক ধাচের গানের জন্য। জীবদ্দশায় প্রায় দুই হাজারের বেশি মৌলিক গান গেয়েছেন তিনি। মিষ্টি ও সুরেলা কণ্ঠের জন্য  তার গাওয়া গান আজো শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বাংলাগানে কালজয়ী এই সুরস্রষ্টা, যার সুরের ঝংকার ছড়িয়ে আছে সমগ্র উপমহাদেশে ।

কিংবদন্তী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৮৯ সালের আজকের এই দিনে (২৬ সেপ্টেম্বর) মৃত্যুবরণ করেন। এই দিনে মহান শিল্পীর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকায় এসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’গানটি। সত্যিই তিনি আর ফিরবেন না, কিন্তু তার সুরের মায়াবী মধুময়তা রয়ে গেছে। রয়ে যাবে পৃথিবী যতদিন থাকে।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একাধারে কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও প্রযোজক। হিন্দি সঙ্গীত জগতে তিনি হেমন্ত কুমার নামে পরিচিত। বাঙালি এই অমর শিল্পী ১৯২০ সালের ১৬ জুন ভারতের পবিত্র শহর বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছোটবেলা কাটে তিন ভাই ও এক বোনের সঙ্গে। বড় ভাই তারাজ্যোতি ছোটগল্প লিখতেন। ছোট ভাই অমল মুখোপাধ্যায় কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন এবংষাটের দশকে কিছু গানও গেয়েছিলেন।

হেমন্ত ভবানিপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু সঙ্গীতের টানে ইঞ্জিনিয়ারিং আর পড়া হয়নি। যাদবপুরেই তার সঙ্গে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়। প্রথমে হেমন্তের সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন তিনি দেশপত্রিকায় লেখালেখিও করেন। কিন্তু যিনি বাংলা গানের অমর এক শিল্পী হবেন, সাহিত্য কি তাকে ধরে রাখতে পারে।

১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৩৭ সাল থেকে সঙ্গীত জগতে তিনি নিয়মিত হন।এই বছর তিনি নরেশ ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানি কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদিগো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি  গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৪০ সালে সঙ্গীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত, হেমন্তকে দিয়ে ফাইয়াজ হাসমির কথায় ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ ও   ‘ও প্রীত নিভানে ভালি’ গান দুটি গাওয়ান।

আর ১৯৪১ সালে তার প্লে-ব্যাক সঙ্গীত জীবন শুরু করেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির মাধ্যমে। এরপর থেকেই তিনি ভারতীয় বাংলা সিনেমার একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে পরিণত হন। আর শ্রোতারা পেতে থাকে একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান। ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করে হিন্দি গানের শ্রোতাদেরকেও নিজের জাত চেনান হেমন্ত। একই বছরে হেমন্ত প্রথম নিজের কম্পোজিশনে দুটো গান করেন। গান দুটির গীতিকার ছিলেন অমিয় বাগচী।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত শিল্পী ও কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। ১৯৫৪ সালে বলিউডের সিনেমা ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই ছবির গান সেসময় দুই বছর ধরে টপচার্টের শীর্ষে অবস্থান করে। এই সিনেমার জন্যই হেমন্ত ১৯৫৫ সালে ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর’ এর পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলা সিনেমা ‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের জন্য চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান।

ব্যক্তি জীবনে ১৯৪৫ সালে বেলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন । বেলাও সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর তিনি আর সঙ্গীত জগতে থাকেননি। হেমন্তের দুই সন্তান। ছেলে জয়ন্ত, মেয়ে রাণু।

হেমন্ত মুখপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গানগুলি হলো : ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো’, ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘আয় খুকু আয়’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘মেঘ কালো, আঁধার কালো’, ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’, ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, ‘কেন দূরে থাকো’, ‘ওলিরও কথা শুনে বকুল হাসে’ ইত্যাদি।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে রেকর্ড করেছিলেন ‘আমার শ্মশানে কতো লোক হবে’ গানটি। তিনি বেঁচে থাকতেই রেডিওতে প্রচার হয়েছিল গানটি। শ্রোতাদের কাছে গানের কথাগুলি কেমন যেন লেগেছিল। কিন্তু হেমন্ত পাত্তা দেননি। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গেয়েছিলেন গানটি।এই গানটি গাওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মারা যান।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়