ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কাঁকড়ার জন্য বনবাস

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাঁকড়ার জন্য বনবাস

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : একটা সময় ছিল যখন মানুষকে শাস্তিস্বরূপ বনবাসে পাঠানো হতো। এ যুগেও মানুষ বনবাসে যায়, তবে তা অপরাধের দণ্ড হিসেবে নয়। স্বেচ্ছায় যায় নিজেদের জীবন জীবিকার তাগিদে। বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে গিয়ে হাজারো বনজীবী স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন যাপন করে। সুন্দরবনে কেউ যায় মাছ ধরতে, কেউ যায় কাঠ সংগ্রহ করতে, কেউ মধু সংগ্রহ করতে। আবার কেউ যায় কাঁকড়া শিকারে।

পরিবার ছেড়ে মাসের পর মাস তারা পড়ে থাকে বনে। সুন্দরবনের তেমনি এক কাঁকড়াশিকারি আবদুল হাকিম। দশ বছর ধরে তিনি সুন্দরবন এলাকায় কাঁকড়া শিকার করছেন। হাকিমের বাড়ি সুন্দবনের পাশ ঘেঁষা শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের নীলডুমুর এলাকায়। তিনি সাধারণত দৌবাইকে, আট পাঙ্গাসিয়া ও কুনচি এলাকায় কাঁকড়া শিকার করেন।

হাকিম ও তার বন্ধু স্বপন। দুই সদস্যের কাঁকড়াশিকার টিম। স্থানীয় বন বিভাগ থেকে পারমিট নিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকায় এক মাসের জন্য তারা চলে যান বনের ভিতরে। সঙ্গে নিয়ে যান চাল, ডালসহ দরকারি প্রয়োজনীয় খাবার ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিস। ডিঙ্গিতে রাত্রী যাপনের জন্য থাকে কাঁথা বালিশও।

কাঁকড়া ধরার বিশেষ ফাঁদ দৌন দড়ি এবং খাবার হলো কুঁচে। কাঁকড়া ধরার কৌশল সম্পর্কে হাকিম জানান, একটা দড়িতে কুঁচে বেঁধে নদীতে ফেলেন। কাঁকড়া খাবার কামড়ে ধরলে, ছোট্ট বিশেষ জাল দিয়ে তুলে ফেলেন। সুন্দরবনে প্রতিদিন জোয়ার ভাটার হিসেব করে কাঁকড়া ধরতে হয়। ছয় ঘণ্টা জোয়ার, ছয় ঘণ্টা ভাটা, জোয়ারের সময় কাঁকড়া বেশি পাওয়া যায়। তাই ছয় ঘণ্টা কাঁকড়া ধরেন, বাকি ছয় ঘণ্টা রান্না-বান্না, খাওয়া আর বিশ্রাম। হাকিম জানান, এক মাসের খাবারের জন্য তারা সঙ্গে নিয়ে যান ৩০ কেজি চাল, ৫ কেজি ডাল, ৫ কেজি আলু, প্রয়োজন মতো রসুন, পেঁয়াজ, তেল, শুকনো খাবার, ৬০ লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানি। রান্নার জন্য ঝাকি জাল দিয়ে নদী থেকেই মাছ ধরে নেন।



প্রতি ডিঙ্গি নৌকায় প্রতিদিন ১০-১৫ কেজি কাঁকড়া ধরতে পারেন। জীবন্ত কাঁকড়াগুলো বেঁধে রাখেন নৌকায়। সপ্তাহে দেড়-দুই মণ কাঁকড়া জমলে অন্য ডিঙ্গি নৌকায় পাঠিয়ে দেন জনপদে। এভাবে পুরো বছর কাঁকড়া শিকারিরা কাঁকড়া ধরেন। কেবল বছরে দুই মাস কাঁকড়া ধরা থেকে বিরত থাকে তারা। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হওয়ায় এই সময় সরকারি ভাবে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ।

আবদুল হাকিম রাইজিংবিডিকে জানান, দেশ-বিদেশে কাঁকড়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায়, কাঁকড়ার চাহিদা প্রচুর। ভালো গ্রেডের কাঁকড়া প্রতি কেজি ৫০০ টাকা। আর খুচরো ছোট ছোট কাঁকড়ার দাম ১০০ টাকা। ভালোমতো কাঁকড়া ধরতে পারলে ১৫ দিনের এক চালানে ২০ হাজার টাকার কাঁকড়া বিক্রি করা যায়।

সুন্দরবনে কাঁকড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শ্যামনগরের প্রায় পাঁচশ কাঁকড়াশিকারি। সুন্দরবনের কাঁকড়াকে কেন্দ্র করে শ্যামনগর কালীবাড়ি, নীলডুমুর এলাকায় গড়ে উঠেছে কাঁকড়ার মোকাম। যেখান থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হয় ভারত, জাপান ও চীনে।

হাকিম জানান, মাঝে মাঝে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে সুন্দরবনে জলদস্যুদের খপ্পরে পড়তে হয়। তারা কাঁকড়া শিকারিদের অপহরণ করে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করে। তিনি নিজেও তিন বার জলদস্যু দ্বারা অপহরণের শিকার হয়েছেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ