ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আজ তিনি নিজের নামেই পরিচিত

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৪ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আজ তিনি নিজের নামেই পরিচিত

রেহানা আক্তার, ছবি: আসিফ মোসাদ্দেক

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: তখনো তার পুতুল খেলার বয়স পেরিয়ে যায়নি। বান্ধবীদের সঙ্গে সব সময় মেতে থাকতেন দুষ্টুমিতে। কখনো ধলেশ্বরী নদীতে অবাধ সাঁতার, কখনো খেজুরের রস চুরি করে পায়েস রান্না করা, আবার কখনও সময় পেলেই করতেন চড়ুইভাতির আয়োজন। তখন বয়স মাত্র তেরো। সেই বয়সেই বাল্যবিয়ের শিকার হন তিনি। তবে বাল্যবিয়ে তাকে দমাতে পারেনি। জীবনে যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করলেন সেখান থেকেই নিলেন শিক্ষা। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। বন্ধ করলেন হাজারো কন্যাশিশুর বাল্যবিবাহ। তিনি বাংলার সংগ্রামী নারীর উদাহরণ। নাম রেহানা আক্তার।

রেহানা আক্তারের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার হাজিপুর। বাবার চাকরির কারণে পাঁচ বছর বয়স থেকেই দিনাজপুরে বেড়ে ওঠা। বাবা তাহের উদ্দিন আহমেদ। মা সাজেদা বেগম। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। দিনাজপুর দক্ষিণ বালুয়াডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রেহানার শিক্ষাজীবন শুরু। মাধ্যমিক দিনাজপুর ইকবাল হাই স্কুলে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন হঠাৎ জীবনের ছন্দপতন। দাদীর কারণে তেরো বছরের মেয়েকে বিয়ে দিলেন বাবা। তবে শর্ত ছিল বিয়ের পর রেহানাকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে হবে।

শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রেহানা আবিষ্কার করলেন তিনি এখন আর সেই ছোট মেয়েটি নন। তিনি এখন বাড়ির বউ। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন তারা চান না বউ পড়াশোনা করুক। তারা বলতেন, বাড়ির বউ কেন পড়বে? ঘর সামলানো বউয়ের কাজ। তারপরও রেহানা পড়েছেন। বছর দুয়েকের মধ্যেই অনুভব করলেন মা হতে চলেছেন। চমকে উঠলেন এই ভেবে- ‘শিশুর পেটে আরেক শিশু!’ এই কথাটিই তাকে ভাবিয়ে তুলছিল। গর্ভের সন্তান নিয়েই ক্লাস করলেন, পরীক্ষা দিলেন। প্রথম বিভাগে লেটার মার্কস নিয়ে এসএসসিও পাস করলেন। সন্তান জন্মের পর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। এবার পরিবার থেকে বলা হলো- যথেষ্ট হয়েছে, লেখাপড়া বন্ধ। হাল ছাড়লেন না তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন, একবার থেমে গেলে নতুন করে শুরু করা অনেক বেশি কঠিন হবে। তিনি বাবা আর মার সহযোগিতায় এবং অগাধ আত্মবিশ্বাস নিয়ে একটু একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চললেন। দিনাজপুর কেবিএম কলেজ থেকে ২য় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও সন্তান ছোট থাকায় পড়তে পারলেন না। ভর্তি হলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সে রংপুর কারমাইকেল কলেজে। তবে স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেলেন না। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখবেন- এই স্বপ্ন তার চিরকালের। এদিকে এলো চাকরির সুযোগ। চাকরি করার পাশাপাশি  বিএ পরীক্ষা দিলেন এবং উত্তীর্ণ হলেন। কীভাবে সম্ভব হলো- এতো কিছু সামলে ওঠা? রাহেনা বেগম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘খুব ভোর বেলা উঠে সংসারের কাজ শেষ করতাম। বাচ্চার দেখাশোনা করতাম। তারপর অফিস যেতাম। বাসায় ফিরে আবার ঘরের কাজ। এরপর রাত জেগে চলত পড়াশোনা। প্রতিদিন চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারতাম না।’

 


রেহানা আক্তার এরই মধ্যে অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট হতে সুযোগ পান সাংবাদিকতায় সালমা সোবহান ফেলোশিপ করার। সেই সুবাদে বহুদিন মুক্ত সাংবাদিকতা করেছেন। ঢাকায় আসার সুযোগ পেয়েই ভর্তি হয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটে। পাশাপাশি কাজ করেছেন ট্টেনিং, পাবলিক রিলেশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসন, অ্যাকাউন্টস্, মিডিয়া, মাইক্রোক্রেডিট এবং মানবাধিকার নিয়ে। বর্তমানে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্টুডেন্ট ওয়েল ফেয়ারের উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি জানান, নারী হওয়ায় কর্মজীবনে তিনি নানা বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। পুরুষের ভাবটাই এমন, নারী যেন অন্য গ্রহের মানুষ। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থার এখনো পরিবর্তন হয়নি। তবে অনেক ভালো মনের পুরুষ এখনও আছে বিধায় এতদূর আসা সম্ভব হয়েছে।

এই দীর্ঘ সময়ে চাকরি জীবনে একা একা নিজের সঙ্গে, সমাজের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। তেরো বছর বয়সের একটি মেয়ে বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়েও সমস্ত প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন জীবনের পথে। আজ তিনি নিজ নামেই সামাজিকভাবে পরিচিত। রেহানা আক্তার বলেন, আমি কখনো বাবার পরিচয়ে কিংবা স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইনি। আমি চেয়েছি নিজের নামে পরিচিত হতে। 

মুখের হাসি, আর একাগ্রতা দিয়ে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছেন। কারও প্রতি রাগ কিংবা ক্ষোভ রাখেননি। একমাত্র সন্তান তার সকল কাজের প্রেরণার উৎস। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছেন। যেখানে বাল্যবিবাহের খবর পেয়েছেন, ছুটে গিয়েছেন। কন্যা শিশুর মা-বাবাকে কাউন্সিলিং করেছেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় বহু বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। তিনি মনে করেন নারীরা যদি একটু সচেষ্ট হন, তাহলেই তারা সমাজের তথাকথিত নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে পারবেন। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজের সকল কাজে নিজেদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে পারবেন। তিনি জানান, কোনো কন্যা শিশুকে যেন বাল্যবিবাহের বেড়াজালে পড়তে না হয়। সেজন্য প্রথমেই বাবা-মাকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ বাল্যবিবাহ হলো সমাজের ব্যাধি, এই ব্যাধি নির্মূল করতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়