ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাংলা কবিতায় ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’ সুধীন্দ্রনাথ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১১, ৩০ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা কবিতায় ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’ সুধীন্দ্রনাথ

হাসান মাহামুদ: রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। সর্বব্যাপী নাস্তিকতা, দার্শনিক চিন্তা, সামাজিক হতাশা এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবাদ তাঁর কবিতার ভিত্তিভূমি।

আমার অবিশ্বাস নামক গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব নামক গ্রন্থে আবদুল মান্নান সৈয়দ সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে লিখেছেন। গত শতাব্দির ত্রিশ দশকের কবিদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্তই বেশি আলোচিত হয়েছেন।

বিশ শতকে বুদ্ধির দীপ্তি কিংবা প্রতিভার বিশেষ আবেশে বাংলা সাহিত্যকে যারা অগ্রসরতার পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেছেন, তাদের মধ্যে অবশ্য-বিবেচ্য ব্যক্তিত্ব এই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বাংলা কবিতায় ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’ হিসেবে খ্যাত।

বলা যেতে পারে, ‘ক্লাসিকাল’ অর্থে ‘ধ্রুপদী’ শব্দটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তেরই উদ্ভাবনা। নানান বিদ্যায় বিদ্বান এবং বহুভাষাবিদ এ কবি মনস্বী তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তথ্য ও তত্ত্বে আসক্ত মানুষ হিসেবে তিনি সমকালে ও উত্তরকালে প্রশংসিত হয়েছেন। সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুভাষাবিদ পন্ডিত এবং মনস্বী। তার কবিতায় নাগরিক জীবনের জটিলতা, বিশ্বযুদ্ধজনিত শূণ্যতা, মূল্যবোধ সব কিছুই সুন্দর ভাবে লক্ষ্য করা যায়। তিনি ছিলেন যথার্থই একজন আধুনিক কবি। বিংশ শতকের ত্রিশ দশকের যে পাঁচ জন কবি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব কাটিয়ে আধুনিকতার সূচনা ঘটান তাদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ অন্যতম।

দার্শনিক চিন্তা, সামাজিক হতাশা এবং তীক্ষ্ন বুদ্ধিবাদ তার কবিতার ভিত্তিভূমি। তার কবিতা আবেগের জটিলতার নিরিখে কঠিন বাস্তবতায় অন্তর্ভুক্ত। বে কোনো রকম দ্বিধা না রেখেই বলা যায়, তার কবিতায় রোমান্টিকতার ছাপ অত্যন্ত প্রবল। ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক যে সকল কারণে কবির কলম কাজ করে সুধীনের ধীশক্তিও কলমের কালির পথ ধরে ওই একই প্রয়োজনে নিয়োজিত ছিল।

তবে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি সীমাবদ্ধতা ছিল। আধুনিক কালের অনেক কবি বলেছেন, তার কাব্যে আধ্যাত্মিক মুক্তির কথা নেই। আছে সর্বব্যাপী নাস্তিকতা।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ১৯০১ সালের আজকের দিনে (৩০ অক্টোবর) কলকাতার হাতিবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মায়ের নাম ইন্দুমতি বসুমল্লিক। সুধীন দত্তের বাল্যকাল কেটেছে কাশীতে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাশীর থিয়সফিক্যাল হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পরে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯২২ সালে স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য ও আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত যথারীতি পড়াশোনা চালিয়ে যান।

তার চাকরিজীবন শুরু হয় লাইট অব এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ১৯৩১ সালে পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ বছর ধরে সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। স্টেটসম্যান ও শরৎ বসুর লিটারারি কাগজে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুধীন্দ্রনাথকেই আধুনিক আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্বকবি লিখেছেন- বাংলা সাহিত্যে তুমিই যথার্থ আধুনিক। এমনকি রবীন্দ্রনাথ তার ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যটি সুধীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। সুধীন্দ্রনাথের লেখা ‘কুক্কুট’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হয় এবং তাঁর নির্দেশে এটি প্রবাসী সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

সুধীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলো ‘তন্বী’। এটি ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়। সুধীন্দ্রনাথ কিছু সনেট রচনা করেন যার কিছু তন্বী কাব্যে স্থান পায়। ১৯২৫ এ লেখা তিনটি সনেট এতে স্থান পায়। সুধীন্দ্রনাথের মোট সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। তন্বী (১৯৩০) অর্কেষ্ট্রা (১৯৩৫). ক্রন্দসী (১৯৩৭) উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০) সংবর্ত (১৯৫৩) দশমী (১৯৫৬) প্রতিষ্ঠান (১৯৫৪) প্রভৃতি। এছাড়াও তার দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে, স্বগত (১৯৩৮) এবং কুলায় ও কালপুরুষ (১৯৫৭)।

সুধীন্দ্রনাথের কাব্যশক্তি পরিপূর্ণরুপে প্রকাশ পায় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ অর্কেষ্ট্রায়। অর্কেষ্ট্রা যেন বিশ শতকের এক প্রাণবন্ত তরুণী। তিনি কালের অনিবার্যতার কথা শুনিয়েছেন বার বার। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রন্দসী’ সুধীন্দ্রনাথের একটি অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এটি কবি তার পরমবন্ধু ‘হামফ্রে হাউস’কে উৎসর্গ করেন। এই কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা হল, ‘উটপাখি’। উটপাখি এখানে প্রতীক। মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ। যে চোখ,কান ঢেকে মিথ্যা ছলনার আশ্রয় নিয়ে বসে আছে মরুভূমির বুকে। এলিয়টের কবিতার প্রভাব এখানে পরিলক্ষিত হয়। চিত্রকল্প ব্যবহারে কবি তার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অভিভাবকীয় সুরে কবি এখানে নির্মাণ করেছের কবিতার কথামালা।

চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘সংবর্ত’ একটি স্বপ্নভঙ্গের কাব্য। একটি আদর্শের মৃত্যু ঘটেছে এই খানে। এইপর্বে কবি এগিয়ে যাওয়ার কথস বলেছেন।পুরাণের চিত্রকল্প কবি এখানে সচেতনভাবে প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই কাব্যের নাম কবিতায় কবি বিশ্বমানবিকতার যথার্থ রুপ তুলে ধরেছেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ অক্টোবর ২০১৭/হাসান

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়