ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শ্যামাবাবু নেই, তার খালও নেই

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্যামাবাবু নেই, তার খালও নেই

প্রশস্ত খাল এখন সরু ড্রেন

শাহেদ হোসেন : টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাক্ষাৎকার শেষ করে স্কুল থেকে বের হওয়ার পর জোর করেই ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে গেলেন একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি আব্দুর রহিম ভাই। খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে তার কাছে জানতে চাইলাম টাঙ্গাইল শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শতবর্ষী শ্যামাবাবুর খালটি কোথায়।

লাচ্ছির গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে তার নির্লিপ্ত উত্তর ‘আমরা যে জায়গায় বসে আছি তার নিচে।’

আমার ভ্যাবাচ্যাকা মার্কা চেহারা দেখে রহিম ভাই বললেন, ‘এই খালের অস্তিত্ব এখন আর নেই। এটা এখন ড্রেনে পরিণত হয়েছে । আর এই ড্রেনের ওপরই গড়ে উঠেছে রেস্তোঁরা, ফাস্টফুডের দোকানসহ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আপনারা মারছেন ঢাকার খাল, আর আমরা মেরেছি টাঙ্গাইল শহরের খাল।’ বেশ ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো শেষ করলেন স্থানীয় এই সাংবাদিক।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকটি নাগরিক সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহরের সৌন্দর্যবর্ধন ও বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ১৯০৬ সালে টাঙ্গাইল পৌরসভার উদ্যোগে তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান শ্যামাচরণ দাশগুপ্ত এই খাল খনন করিয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া রোডের দক্ষিণ পাশ দিয়ে খালটি খনন করা হয়। টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম দিকে লৌহজং নদী এবং পূর্ব দিকে বুড়াই নদীর সঙ্গে এই খালের সংযোগ ঘটানো হয়। শ্যামাচরণ দাশগুপ্তের নামানুসারে পরবর্তী সময়ে এটি শ্যামাবাবুর খাল হিসেবে পরিচিতি পায়। খালের দুই পাড়ের মানুষের পারাপারের জন্য বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছিল।

পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা’র টাঙ্গাইল জেলার জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিড়ি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানালেন, বুড়াই নদীতে শহরের বর্জ্য বের হয়ে যাওয়ার জন্য এই খাল খনন করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালেও এই খালে বোয়াল মাছ পাওয়া যেত।

তিনি বলেন, ‘আমি তখন বিন্দুবাসিনী স্কুলের ছাত্র। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্কুল আর হোস্টেলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের কিনারায় চলে আসতাম। এখানে এসে বন্ধুরা মিলে ডাইভ দিতাম। স্রোতের টানে বের হয়ে যেতাম বাকা মিয়ার ব্রিজের নিচে। লৌহজংয়ের পানি এই খাল দিয়ে প্রবেশ করায় স্রোতের তীব্রতাও ছিল বেশ। খালটির বেশ কয়েকটি জায়াগায় নৌকার ঘাট ছিল। এখানে আখ, পাটসহ বিভিন্ন শস্য ও পণ্যবোঝাই নৌকা ভিড়ত। আমরা সেসব নৌকা থেকে আখ টেনে নিয়ে খেতাম।’

আশির দশকে খালটিতে পানি প্রবাহ কম ছিল বলে জানালেন ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে অবস্থিত পলল প্রকাশনীর স্বত্ববাধিকারী ও টাঙ্গাইলের অজানা ইতিহাস বইয়ের লেখক খান মাহবুব। তিনি বলেন, ‘ আশির দশকে আমি বিন্দুবাসিনী স্কুলের ছাত্র ছিলাম। শুকনো মৌসুমে খাল শুকিয়ে গেলে আমরা হেঁটেই খাল পার হয়ে স্কুলে যেতাম। বর্ষা মৌসুমে খালে বেশ পানি থাকতো।’

 



বেলা’র জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিড়ি বলেন, ‘২০০১ সালে এনজিও, পৌর প্রশাসন ও চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে খালের ওপর বক্স কালভার্ট নির্মাণের বিষয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসে। কালভার্টের ধরন হিসেবে তারা আমাদের কাছে থাইল্যান্ডের তাং মুং প্রজেক্টের বিষয়টি তুলে ধরে। এই তাং মুং প্রজেক্টের আওতায় খাল থেকে প্রপেলার দিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয়। আমরা তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, এই প্রজেক্ট এখানে চলবে না। কারণ, এখানে যে সলিড বর্জ্য আসবে খালে পানি প্রবাহ না থাকার কারণে তা শক্ত হয়ে যাবে। এসব ময়লা জমে শেষ পর্যন্ত খাল নষ্ট হবে।’

বেলা’র এই কর্মকর্তা জানালেন, অমীমাংসিতভাবে সেই বৈঠক শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরে ড্রেন নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যায়।

শহরের যেসব অংশ দিয়ে খালটি প্রবাহিত ছিল সেই অংশগুলো এখন বদ্ধ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামাবাবুর খালের কোনো চিহ্নই নেই, পাকা ড্রেনে রূপ নিয়েছে সেটি। ড্রেনের একপাশ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে দোকান, মার্কেট।

নিরালা মোড় থেকে ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত গড়ে ওঠা স্থায়ী দোকানের সংখ্যা হাজার হতে পারে বলে জানালেন স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি। সরেজমিনে নিরালার মোড়, পার্কের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ড্রেনের চারপাশে ময়লা উপচে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

সোমনাথ লাহিড়ি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন এই ড্রেনটিকে পরিষ্কার করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তবে এ কাজটিও ঠিকমতো করা হয় না। পরিষ্কার না করার কারণে একসময় মিথেন গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটবে। আর এতে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরন অবশ্য বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘এখন নিয়মিতই এই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘ড্রেনটি যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি।  আমার আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা দোকান নির্মাণ করিয়েছেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক দোকান ভেঙে দিয়েছি। পৌরসভার উদ্যোগে নিয়মিত এই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। সামনে এ ব্যাপারে আরো উদ্যোগ নেওয়া হবে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ অক্টোবর ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়