ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভিনদেশি বন্ধু

ওডারল্যান্ড : মুক্তিযুদ্ধের অহঙ্কার

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ১ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওডারল্যান্ড : মুক্তিযুদ্ধের অহঙ্কার

ইয়াসিন হাসান : ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন করতে আমাদের দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে।  পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা, নিপীড়ন, দুর্দশা কাটিয়ে লাল-সবুজের জয় হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশি না হয়েও এদেশের নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এক ঝাঁক ভিনদেশি বন্ধু। আমাদের ক্রান্তিকালে তারা আমাদের পাশি দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে তারা এসেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিভিন্নভাবে রেখেছিলেন অবদান।  তাদের সেই মহান আত্মত্যাগের কারণেই আজ আমরা পৃথিবীর বুকে স্বাধীন এক জাতি।  বিজয়ের এই মাসে ভিনদেশি বন্ধুদের নিয়ে রাইজিংবিডি’র বিশেষ আয়োজন। আজ  রইল এস এ ডব্লিউ ওডারল্যান্ডের কথা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে কজন ভিনদেশি বন্ধু অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে এস এম ডব্লিউ ওডারল্যান্ড। নামটি বাংলাদেশে বেশ পরিচিত,  সমাদৃত। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে ওডারল্যান্ড সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ সম্মান বীরপ্রতীক-এ (বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব) ভূষিত করেন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ  ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল এবং অসীম সাহসের কারণে বাঙালিরা বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের প্রেরণা পেয়েছিল।

ওডারল্যান্ড ছিলেন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করার সুযোগ তার হয়নি। জীবিকার তাগিদে অল্প বয়সে শুরু করেন  জুতা-পালিশের কাজ। তবে এ পেশায় বেশিদিন থাকতে হয়নি। বাটা সু কোম্পানিতে কাজের সুযোগ হয়। মেধাবী হওয়ায় দ্রুত সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন ওডারল্যান্ড। ১৯৭০ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ঢাকায় বাটা সু কোম্পানিতে আাসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

সব কিছুই ভালোই চলছিল। কিন্তু একাত্তরের ২৫ মার্চের রাত পাল্টে দেয় তার জীবন। অপারেশন সার্চলাইট এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর  হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করায় রক্তেই তার ছিল স্বাধীনতার নেশা। তাই পরাধীন বাঙালির পাশে দাঁড়ান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

১৯১৭ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন ওডারল্যান্ড। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৫৪। বাটা কোম্পানিতে কাজের সুবাদে সর্বত্র ছিল তার অবাধ বিচরণ। এই সুযোগটি তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে পাকিস্তান থেকে তিনি নিয়ে আসেন পশ্চিম পাকিস্তান বাটার পার্সোনেল ম্যানেজার কর্নেল (অবঃ) নেওয়াজকে। তাকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লে. জে. টিক্কা খান ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. নিয়াজি, রাও ফরমান আলীর সঙ্গে পরিচিত হন। ঢাকা সেনানিবাসে যাতায়াতের কারণে সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানিদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করেন।  গোপন তথ্য প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে। তার দেওয়া গোপন তথ্যের ভিত্তিতেই পরিকল্পনা তৈরি করা হয় কীভাবে শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে। শুধু সেনানিবাসেই তার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা, টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন ওডারল্যান্ড। এক রাতে বাঙালি যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হলো। আরও ৬ বছর বাংলাদেশে কাজ করে ১৯৭৮ সালে ফিরে যান অস্ট্রেলিয়া। ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মারা যান। তবে মৃত্যুর আগেই বাংলাদেশ থেকে বীরপ্রতীক সম্মাননা পান। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ ভিনদেশি এ বন্ধুকে সম্মান জানায় বাংলাদেশ সরকার। অসুস্থ থাকায় বাংলাদেশে আসতে পারেননি। বীরপ্রতীক পদকের সম্মানী দান করে দেন  মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে।

বাংলাদেশ ছিল ওডারল্যান্ডের খুব কাছের। তাই শেষ দিন পর্যন্ত বীরপ্রতীক খেতাবটি নামের পাশে লিখে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেছেন।  বিজয়ের মাসে গভীর চিত্তে আমরা স্মরণ করছি ওডারল্যান্ডকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তিনি নায়ক হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

তথ্যসূত্র : বাংলা উইকিপিডিয়া



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ডিসেম্বর ২০১৭/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়