ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভিনদেশি বন্ধু

পল কনেট দম্পতি: অকৃত্রিম যুদ্ধবন্ধু

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪১, ২ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পল কনেট দম্পতি: অকৃত্রিম যুদ্ধবন্ধু

ইয়াসিন হাসান : ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন করতে আমাদের দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে।  পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা, নিপীড়ন, দুর্দশা কাটিয়ে লাল-সবুজের জয় হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশি না হয়েও এদেশের নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন যারা, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে রেখেছেন অবদান, এমনকি অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন, সেইসব ভিনদেশি বন্ধুদের নিয়ে বিজয়ের এই মাসে রাইজিংবিডি’র বিশেষ আয়োজন। আজ প্রকাশিত হলো এর দ্বিতীয় কিস্তি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভিনদেশি বন্ধু যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে পল কনেট দম্পতি অন্যতম। ইংরেজ এ দম্পতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজ দেশে কাজ করেছেন। এজন্য কারাভোগও করতে হয়েছে। তবুও পিছপা হননি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালির জন্য লন্ডনে খাদ্য ও ওষুধ সংগ্রহ করেন তারা । এরপর সেগুলো বাংলাদেশে নিয়ে এসে বিতরণ করেন। এখানেই থেমে থাকেননি। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন জানিয়ে এবং জনমত গঠনের জন্য ১৯৭১ সালে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনসভা করেন পল কনেট।

বাংলাদেশে আসার আগে পল কনেট প্যারিসে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের একটি পতাকা হাতে ‘জয় বাংলা’শ্লোগান দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পুরো দৃশ্যটা টিভিতে ধারণ করা হয় এবং এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন- তুমি তো বাঙালি নও, ইংরেজ, তুমি একা কীভাবে ইয়াহিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বে আর বাংলাদেশ স্বাধীন করবে? পতাকা নাড়তে নাড়তে পলের দৃঢ় উচ্চারণ ছিলো- দেখোই না আমি কী করতে পারি!

সত্যিই পল কনেট করে দেখিয়েছেন। গেয়েছেন মানবতার জয়গান। প্রতিবাদ করেছেন অন্যায়ের। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সবটুকু শক্তি নিয়ে। তাকে সঙ্গ দিয়েছেন স্ত্রী অ্যালেন কনেট। ভালোবেসে অ্যালেন বিয়ে করেছিলেন পলকে। দুজনেই ছিলেন অ্যাকটিভিস্ট। লন্ডন ভিত্তিক War Resisters’ International (WRI) সংগঠনের কর্মী ছিলেন। WRI যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের সাহায্যে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কনেট দম্পতি এখানে আসার আগ্রহ দেখায়। ছোটো ছোটো ভাগ হয়ে WRI তাদের কর্মীদের নিয়ে চালু করে ‘অপারেশন ওমেগা’। ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ৮ জনের একটি দল নিয়ে উদ্বোধন হয় ‘অপারেশন ওমেগা’র। শুরুতে ৫ সেপ্টেম্বর ‘অপারেশন ওমেগা’র চার জনের দল ত্রাণ নিয়ে ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। ১১ দিন তাদের আটকে রেখে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই দিন আরেকটি সফল মিশন করে ‘অপারেশন ওমেগা’। আরেক সীমান্তে দুই জনের দল খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ ও কাপড় বাঙালিদের মাঝে বিতরণ করেন। ১০ সেপ্টেম্বর আবারও তাদের তিন জনের একটি দল বাংলাদেশে এসে ত্রাণ বিতরণ করে।

অক্টোবরের শুরুতে পল কনেট দম্পতি শিমুলিয়া প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে ছিল দুইশর কাছাকাছি শাড়ি, শীতের জন্য গরম কাপড় ও শুকনো বিস্কুট। সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়লেও বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারেননি। ৪ অক্টোবর স্থানীয় এক গীর্জা থেকে তাদের এসব ত্রাণসামগ্রী জব্দ করা হয় এবং তাদের গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সেনারা। অভিযোগ এই দম্পতি বাঙালিদের সাহায্য করছে। সামরিক আদালতে তাদের বিচারও হয়। বিচারে শাস্তি হলো দু’বছরের জেল। তাদের পাঠানো হয় যশোর কারাগারে। কিন্তু পুরো মেয়াদে জেল খাটতে হয়নি।

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোর জয় হওয়ার পর কারাগার থেকে মুক্তি পান পল কনেট দম্পতি। বাংলাদেশের বিজয় দেখার সুযোগ হয়েছিল তাদের। হাজারো বাঙালির সঙ্গে রাস্তায় নেমে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন তারাও। যশোর কারাগারে অ্যালেন কনেট যখন বন্দি ছিলেন তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। পরের বছরের মাঝের দিকে তিনি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার হৃদয়ে এতটাই জায়গা করে নিয়েছিল যে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অনুসারে তার ছেলের নাম রাখেন- পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট। কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছেয় তারা বাংলাদেশে আসেননি। এসেছিলেন মানবতা, বিবেকের ডাকে।

২০১৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে এসেছিলেন পল কনেট। ৫ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র: ‘অপারেশন ওমেগা’, জন্মযুদ্ধ ৭১



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ডিসেম্বর ২০১৭/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়