ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভিনদেশি বন্ধু

নিকোলাই পদগর্নি: মুক্তিযুদ্ধের আরেক বন্ধু

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১২, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিকোলাই পদগর্নি: মুক্তিযুদ্ধের আরেক বন্ধু

ইয়াসিন হাসান : ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন করতে আমাদের দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে।  পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা, নিপীড়ন, দুর্দশা কাটিয়ে লাল-সবুজের জয় হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশি না হয়েও এদেশের নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন যারা, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে রেখেছেন অবদান, এমনকি অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন, সেইসব ভিনদেশি বন্ধুদের নিয়ে বিজয়ের এই মাসে রাইজিংবিডি’র বিশেষ আয়োজন। আজ প্রকাশিত হলো এর তৃতীয় কিস্তি।

মহান মুক্তযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সমর্থনে ভারত মহাসাগরে নৌবহরও পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেরও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের ‘দোসর’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতাকামী বাঙালির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাশের আবেদন করে। তাতে ভেটো দিয়ে প্রস্তাবটি বাতিল করেন তৎকালিন সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি। প্রস্তাবটি পাশ হলে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যেত। ধূলিসাৎ হয়ে যেত আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন।

নিকোলাই পদগর্নি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানান কার্যক্রম চালাতে থাকেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে সতর্কতামূলক এবং পরবর্তীকালে হত্যা, নির্যাতন বন্ধে পাকিস্তানকে আহ্বান জানায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার বিপক্ষে দেশগুলোর চক্রান্ত ব্যর্থ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।  এসব কিছুই হয়েছে নিকোলাই পদগর্নির বন্ধুপরায়ণতায়।

রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পদগর্নি ২ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠি লেখেন:

‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট মহাশয়,

 

ঢাকার আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার খবর এবং সামরিক প্রশাসন চূড়ান্ত ব্যবস্থা অবলম্বন প্রয়োজন মনে করে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে সামরিক বলপ্রয়োগ করেছেন- এই মর্মে খবর সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর উদ্বেগ সঞ্চার করেছে।

এই ঘটনার ফলে পাকিস্তানের অগণিত মানুষের প্রাণহানি, নিপীড়ন ও দুঃখকষ্টের খবরে সোভিয়েতের জনগণ বিচলিত না হয়ে পারে না। মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দী করায় এবং নির্যাতন করায়ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এইসব নেতারা হালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সন্দেহাতীত সমর্থন লাভ করেছিলেন। সোভিয়েত জনগণ সর্বদাই পাকিস্তানের মানুষের মঙ্গল কামনা করেছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের জটিল সমস্যা সমাধানের তাদের সফলতায় আনন্দিত হয়েছে।

পাকিস্তানের জনগণের কঠিন পরীক্ষার দিনে খাঁটি বন্ধু হিসেবে আমরা দুএকটি কথা না বলে পারি না। আমরা বিশ্বাস করি যে পাকিস্তানে বর্তমানে যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, বল প্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে তার সমাধান করা যায় এবং করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের দমননীতি এবং রক্তপাত যদি চলতে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে সমস্যার সমাধান আরো কঠিন হয়ে উঠবে এবং তাতে পাকিস্তানের সমস্ত মৌল স্বার্থেরই বিরাট ক্ষতি হবে।

প্রেসিডেন্ট মহাশয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে আপনাকে কিছু বলা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। পূর্ব পাকিস্তানের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য এবং সমস্যা সমাধানের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি যে পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের এবং সে অঞ্চলের শান্তিরক্ষার স্বার্থ  এর ফলে রক্ষিত হবে।

 

উদ্ভুত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানকে সমগ্র সোভিয়েত জনগণ সন্তোষের সাথে গ্রহণ করবেন।

আপনাকে আবেদন জানাবার সময় আমরা মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণায় লিপিবদ্ধ সর্বজনস্বীকৃত মানবিক নীতির দ্বারা এবং পাকিস্তানের বন্ধু জনগণের কল্যাণের জন্যে উদ্বেগের দ্বারা পরিচালিত হয়েছি।

প্রেসিডেন্ট মহাশয়, আপনাকে এই অনুরোধ জানাতে আমরা কোন নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়েছি, আশাকরি আপনি তা সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন। আমাদের একান্ত কামনা অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক।”

বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আরও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সকল পর্যায়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ সব সময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন-সহযোগিতার কথা স্মরণ করে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পান নিকোলাই পদগর্নি।

মুক্তিযুদ্ধের পরও বাংলাদেশকে সমর্থন করে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৭২-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি দলসহ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিকে বরণ করতে মস্কো বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পদগর্নি, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন। এটি ছিল একটি বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ১৩তম খণ্ড

সোভিয়েত তথ্য বিভাগ প্রচারিত পুস্তিকা: বাংলাদেশ সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৭/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়