ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সব সময় রেডি আছে কল-রেডী

তাইফুর রহমান তমাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৩, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সব সময় রেডি আছে কল-রেডী

তাইফুর রহমান তমাল: পুরনো ঢাকার বায়ান্নো-বাজার তেপ্পান্নো গলি পেরিয়ে যখন লক্ষ্মীবাজার হয়ে ঋষিকেশ দাস লেনের ‘কল-রেডী’তে পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবে গেছে।

সম্প্রতি একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে যুক্ত হযেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণটি এখন শুধু দেশের সম্পদ নয়, বিশ্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে।

সেদিন জনসভায় ‘কল-রেডী’র মাইক ব্যবহৃত হয়েছিল। এর আগে পরে এবং এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জনসভায় এই প্রতিষ্ঠানের মাইক ব্যবহার করা হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের গৌরবের অংশ। কেমন আছে ‘কল-রেডী’? এ কথা জানতেই গিয়েছিলাম ঋষিকেশ দাস লেনে। বলা হয়ে থাকে, ইতিহাসের প্রয়োজনে ইতিহাস সংরক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শাসকগোষ্ঠী এবং হত্যকারীরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ মুছে দিতে। তারা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কীর্তি। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি সঙ্গত কারণেই। বাঙালির হৃদয়ে এখনও অমলীন জাতির পিতার নাম। আর দেশের রাজনীতিকদের ভালোবাসায় এখনও রয়েছে কল-রেডী। সত্যি বলতে, ৭১ সালেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে জনসভার উদ্যোক্তাদের কাছে প্রতিষ্ঠানটি এখনও বেশ জনপ্রিয়।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, লক্ষ্মীবাজারের দুই সহোদরের হাতে ‘কল-রেডী’র জন্ম ও উত্থান। আরও দুই ভাই পরবর্তী সময়ে এই কাজে সহায়তা করেছেন। দয়াল, হরিপদ, গোপাল ও কানাই ঘোষ- এই চার ভাইয়ের কেউ বর্তমানে বেঁচে নেই। কীভাবে কল-রেডীর জন্ম হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর আটচল্লিশ সাল। মাত্র মাস কয়েক আগে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান নামের দুটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে। এই রকম ওলট-পালট সময়ে ঢাকার সূত্রাপুরের হরিপদ ঘোষ এবং দয়াল ঘোষের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম।
 


তখন পল্টন ময়দানে নিয়মিত সভা-সমাবেশ হতো। এবং সেগুলো মানুষ শুনত। সেখানে অনেক মাইক ব্যবহার করা হতো। হরিপদ ঘোষ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মাইকের ব্যবসা করবেন। ছোটভাইকে সে কথা জানালেন। এরপর দুই ভাই নয়টি মাইক, একটি গ্রামোফোন কিনে ব্যবসা শুরু করলেন। নাম কী দেবেন কোম্পানির? এ প্রসঙ্গে পরিচিত সেলিম চাচা পরামর্শ দিলেন, অলয়েজ রেডি অ্যাট ইওর সার্ভিস অন কল- এই হলো ব্যবসার মূলমন্ত্র। সুতরাং ইংরেজি বাক্যটি সংক্ষিপ্ত করে তিনি ‘আরজা ইলেক্ট্রনিক্স’ নাম রাখার প্রস্তাব দিলেন। আরেকটু সহজ করলে শব্দটি দাঁড়ায় ‘আরজু’। প্রস্তাবটি দুই ভাইয়ের পছন্দ হলো। এই নামেই যাত্রা শুরু করল প্রতিষ্ঠান। পরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের এক ছাত্রের পরামর্শে নাম পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম রাখা হয় ‘কল-রেডী’। অর্থাৎ যে কেউ যে কোনো সময় ডাকলে তাদের প্রতিষ্ঠান মাইক নিয়ে প্রস্তুত থাকবে।

১৯৫২ সাল। মিটিং হবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির জিমনেসিয়াম মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন মাতৃভাষার দাবিতে জ্বলে উঠেছে। তমুদ্দিন মজলিশ হয়ে ভাষা সংগ্রাম ঐক্য পরিষদের নেতারা সবাই একাট্টা। এই আগুন সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় একটাই স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল- রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। এমন একটি সমাবেশের জন্য তাদের কাছে বায়না এসেছে ভেবে রোমাঞ্চিত হলেন কল-রেডীর কর্ণধার দুই ভাই। হরিপদ আরো সরঞ্জাম সংগ্রহে মনোযোগী হলেন। দয়াল রাজনীতিমনস্ক ছিলেন। তিনি ভাবলেন, যদিও রোষানলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তবুও এ ধরনের জনসভার জন্য তারা মাইক সরবরাহ করবেন। কারণ এ তো দেশের কাজ। প্রয়োজনে তারা বিনা পয়সায় সার্ভিস দিতেও রাজি।

সেই শুরু। এরপর কল-রেডী ৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের অসংখ্য  সভা-সমাবেশে মাইক সরবরাহ করে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কণ্ঠ হয়ে ওঠে। আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এ দিনের জনসভার জন্যও কল-রেডীর কাছেই বায়না আসে। কিছু অতিরিক্ত মাইক, জরুরি হ্যান্ড মাইকসহ ইলেক্ট্রিক তার তারা জনসভার জন্য সরবরাহ করেছিল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। গৌরবের ব্যাপার হলো, যে মাইকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেই মাইকেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে ভাষণ দেন।

বর্তমানে হরিপদ ঘোষের চার ছেলে কল-রেডীর দেখভাল করছেন। ত্রিনাথ ঘোষ সাগর প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এখন কেমন ব্যবসা চলছে? জানতে চাইলে তিনি অকপটে জানালেন- খুবই ভালো। কারণ সব সময় রেডি আছে কল-রেডী। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু ‘কল-রেডী’ পায়নি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়