ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পোড়ামাটি স্কুল

গাজী হানিফ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পোড়ামাটি স্কুল

নরসিংদী সংবাদদাতা : পোড়ামাটি স্কুল। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সোনাকুড়ার মডার্ন ব্রিক ফিল্ড নামের ইটভাটায় এই স্কুলটির জন্ম।

সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে ইটভাটার শ্রমিকদের শিশু সন্তানদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন আশরাফুল ইসলাম পলাশ নামের এক যুবক।

‘পোড়ামাটি স্কুল’ গড়ে তোলায় এখানে আশরাফুল ইসলাম পলাশ এখন সবার প্রিয় স্যার।পলাশের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একদুয়ারিয়া ইউনিয়নের মন্ডলদিয়া গ্রামে। পলাশ জানালেন, ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকদের শিশু সন্তানদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতেই এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য।

মাত্র ১৫ জন শিশু নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে চার বছর পূর্বে এই স্কুলের যাত্রা শুরু। এবছর স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮ । শুরুতে ইটভাটার শ্রমিকদের মধ্যে আগ্রহ কম থাকলেও এখন তারা নিজেই শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসেন। পলাশের এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে এ বছর ইটভাটার মালিক আছর আলী সরকার স্কুলের জন্য আধাপাকা টিনশেড ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন।

সরেজমিনে স্কুলটি গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার প্রবেশ পথেই লম্বা আধাপাকা টিনশেড ঘর। তাতে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘পোড়ামাটি স্কুল’। এই ঘরের ভেতরেই পাটি বিছিয়ে মেঝেতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। আর পলাশ এই শিশুদের পড়াচ্ছেন, অ-তে অজগর, আ-তে আম’।

স্কুলের পড়ার মান কেমন, তার প্রমাণ দিল পড়ুয়া শিশুরাই। এই স্কুলে চক, ডাস্টার, ব্লাকবোর্ড, পরীক্ষা -এসব অন্য আট দশটি স্কুলের মতো সবই আছে ।

স্কুলের শিক্ষার্থী জোনাইয়া একাধারে এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত নির্ভুলভাবে অনায়াসে গণনা করল। আরেক শিশু রাজন পড়ে শোনায়- এ থেকে জেড পর্যন্ত ইংরেজি বর্ণমালা।পাঠদানের পাশাপাশি বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চাও হচ্ছে পোড়ামাটি স্কুলে।

 


শিক্ষা বিলিয়ে পলাশ কোনো পারিশ্রমিক নেন না। এমনকি প্রতিমাসে অন্তত হাজার খানেক টাকা স্কুলের জন্য নিজ পকেট থেকেই খরচ করতে হয়।

পলাশ একাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর। কোনো চাকরি না পেয়ে আয়ের উৎস হিসাবে বেছে নিয়েছেন ছোটখাট একটি ব্যবসা। এই ব্যবসার ফাঁকে স্কুলের জন্য সময় দিয়ে থাকেন পলাশ। আর নিজের ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকেই স্কুলের খরচ মেটান ।

পোড়ামাটি স্কুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আশরাফুল ইসলাম পলাশ বলেন, ‘রাস্তার পাশে ইট ভাটায় শীতকালে কিছু  নারী ও পুরুষ একসাথে ইট তৈরির কাজ করতো। আর তাদের সাথে ছোট ছোট সন্তানরা ধুলাবালির মাঝে খেলাধুলা করে। এই মানুষগুলো স্থানীয় না হলেও তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে জানতে পারি, ইট ভাটায় দরিদ্র এলাকার মানুষগুলো অনেকটা কৃতদাসের মতো জীবনযাপন করেন। অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ নেই। শীতের শুরুতে (নভেম্বর মাসের দিকে) ইট ভাটার কাজে ছুটে যান এবং বর্ষার শুরুতে (মে মাসের দিকে) বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। তাই এলাকার কোন স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ হয় না। যাদের পিতামাতা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে ইট তৈরির কাজ করছেন, তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। এমন চিন্তা থেকেই এই ‘পোড়ামাটি স্কুল’।

সমলা বেগম নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এখানে পলাশ স্যারের কারণে লেখাপড়া করছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা আমাদের মতো ইটভাটায় কাজ করবে, এটা আমরা চাইনা।’

ইটভাটার মালিক আছর আলী সরকার বলেন, ‘পলাশের পোড়ামাটি স্কুল আমাকে নাড়া দিয়েছে তাই আমি তার এই সুন্দর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে এবছর স্কুলের জন্য একটি ঘর তৈরি করে দিয়েছি। আমার ইচ্ছা পলাশের গড়া এমন স্কুল প্রতিটি ইটভাটায় গড়ে উঠবে।’

নরসিংদী জেলা স্কুল-কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধা বলেন, ‘পলাশের পোড়ামাটি স্কুল একটি মহৎ উদ্যোগ। দেশের প্রতিটি ইটভাটা কর্তৃপক্ষের উচিত এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া।’

 

 

রাইজিংবিডি/নরসিংদী/২২ জানুয়ারি ২০১৮/গাজী হানিফ মাহমুদ/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়