ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নোট-গাইডের পাঁচ প্রকাশনীর নথিপত্রে দুদকের দৃষ্টি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নোট-গাইডের পাঁচ প্রকাশনীর নথিপত্রে দুদকের দৃষ্টি

এম এ রহমান মাসুম : নোট-গাইড বই বাজারজাতকারী পাঁচ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কাছে তলব করা নত্রিপত্রের অধিকাংশই দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলে এসেছে । চলছে ছয় ধরণের নথিপত্রের যাচাই-বাছাই। আরো কিছু নথিপত্র দুদকে এসে পৌঁছানোর বাকি রয়েছে।

পাঁচ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই বাকি নথিপত্র দুদকে পাঠানোর ক্ষেত্রে সময় চেয়ে আবেদন করেছে। গত ১৮ জানুয়ারি পৃথক পৃথক পাঠানো চিঠিতে ছয় ধরনের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছিলো পাঞ্জেরী, লেকচার, রয়েল, জুপিটার, অনুপম (কাজল প্রকাশনী) প্রকাশনা সংস্থার চেয়ারম্যানের কাছে। চিঠির বিষয়টি দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

চিঠিতে পাবলিকেশন্স লিমিটেড পরিচালনার অনুমোদন, ট্রেড লাইসেন্স ও লিমিটেড কোম্পানি সংক্রান্ত মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস সার্টিফিকেট অব ইন-কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, প্রকাশিত সকল নোটবই/গাইড বই/সহায়ক বইয়ের তালিকা, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ সকল পরিচালক বা মালিকদের নামের হালনাগাদ ব্যাংক হিসাবের বিবরণী, প্রতিষ্ঠানের আয়কর নথির রিটার্ন ও ভ্যাট প্রদান সংক্রান্ত কাগজপত্র, উক্ত প্রতিষ্ঠানের সকল পরিচালক ও মালিকদের আয়কর রিটার্ন, পাসপোর্ট ও এনআইডির ফটোকপি ইত্যাদি নথিপত্র চাওয়া হয়েছিল। যা ২৪ জানুয়ারি মধ্যে পাঠানোর কথা ছিল।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাঁচ প্রকাশনা সংস্থা বেশ কিছু কাগজপত্র সরবরাহ করলেও এর মধ্যে অনুপম ও জুপিটার তাদের সকল নথিপত্র সরবরাহ করতে আরো সময় চেয়েছে। তবে দুদকের পক্ষ থেকে এখনো সময় বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। আশা করা হচ্ছে তারা খুব শিগগিরই সকল নথিপত্র দুদকে সরবরাহ করবে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থাকেও এই অনুসন্ধানের আওতায় আনা হবে।’ 

শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্য, কোচিং কোম্পানি ও শিক্ষকদের একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন ধরে বহাল থাকার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর পর এবার নোট, গাইড বই বাজারজাতকারীদের সম্পদ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। সরকারি অনুমোদনহীন নোট, গাইড বই ছাপিয়ে ও বিক্রি করে ট্যাক্স, ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে প্রকাশনীর মালিকদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্প্রতি দুদকে পেশ করা হয়। পরে অভিযোগ যাচাই করে অনুসন্ধানের অনুমতি দেয় কমিশন। যা  দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে অনুসন্ধান শুরু করা হয়।

এরপরই গত ১০ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ারের নেতৃত্বে টিম গঠন করে কমিশন। টিমের অপর সদস্যরা হলেন উপপরিচালক মুহাম্মদ ইব্রাহিম, সহকারি পরিচালক মাসুদুর রহমান ও মো. আব্দুল ওয়াদুদ।

টিম গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের উপ-পরিচালক প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘মূলত অননুমোদিত ও নিষিদ্ধ গাইড বই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুদক অভিযানে নামছে। দুদক নিষিদ্ধ নোট বই ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে।’

এ বিষয়ে দুদক জানায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেআইনিভাবে নোট-গাইড বাজারে ছেড়ে কোটি কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। অধিকাংশ গাইডই নিম্নমানের। দুদক বেশ কয়েকবার সরেজমিনে বিভিন্ন বই মার্কেট পরিদর্শন করে গাইড ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করেছে। তবে নোট-গাইড বিষয়ে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদক আইনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এজন্য দুদক ব্যবসায়ীদের সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। এর মাধ্যমে তার বৈধ ও অবৈধ আয়ের হিসাব পাওয়া যাবে।

এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল আকস্মিকভাবে রাজধানীর পাঁচটি মার্কেটে অভিযান চালায়। দুদকের বিশেষ দল আকস্মিকভাবে নীলক্ষেত, হজরত শাহজালাল মার্কেট, বাবুপুরা মার্কেট, বাকুশাহ মার্কেট, ইসলামীয়া মার্কেটে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে অনুসন্ধান চালায়। অভিযানে দুদকের দল দেখতে পায় বাজারের প্রতিটি দোকানে অননুমোদিত ও নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানির গাইড বই বিক্রি হচ্ছে। বাজারে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির গাইড বইয়ের মধ্যে অন্যতম প্রকাশনী পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, নবদূত, জননী, পপি ও জুপিটার;  নবম ও দশম শ্রেণির গাইড বইয়ের প্রকাশনী পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, রয়েল, আদিল, কম্পিউটার ও জুপিটার এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির গাইড বইয়ের প্রকাশনী হিসেবে লেকচার, পাঞ্জেরী, জ্ঞানগৃহ, জুপিটার, পপি, মিজান লাইব্রেরি, কাজল ব্রাদার্স, দি রয়েল সাইন্টেফিক পাবলিকেশন্সের বই পাওয়া যায়। এসব গাইড বই, টেস্ট পেপার, সহায়ক বই, মেড ইজিসহ বিভিন্ন নামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। শ্রেণিভিত্তিক গাইড বইয়ের পাশাপাশি ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স শ্রেণির বিভিন্ন গাইড বই এবং প্রফেসর’স, ওরাকল, এমপিও, থ্রি ডক্টরস ও সাইফুরসের চাকরিতে নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন গাইড বাজারে রয়েছে।

দুদক জানায়, দেশে ১৯৮০ সালের নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইন রয়েছে। এই আইনানুসারে গাইড ও নোট বই ছাপা ও বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ছাড়া ২০০৮ সালে নির্বাহী আদেশেও নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধকরণ আইন থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সব শ্রেণির নোট ও গাইড প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে দুদক টিম।

এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস বন্ধে বিষয়ভিত্তিক বেশকিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে দুদক। মন্ত্রিপরিষদের সচিব বরাবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠিতে দুদকের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

পাঁচ পৃষ্ঠার চিঠিতে কোচিং এবং নোট-গাইড বাণিজ্য প্রতিরোধে দুদকের সুপারিশ হলো, শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান না করা, কোচিং  মালিক ও কিছু শিক্ষকের অবৈধভাবে স্বল্প সময়ে সম্পদ অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রমের মনিটরিংয়ের অভাব এবং অভিভাবকদের অসচেতনতা ইত্যাদি দুর্নীতির মূল উৎস। এক্ষেত্রে দুদক মনে করে, যেসব শিক্ষক একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন বহাল থেকে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনৈতিক অর্থ উপার্জন করছেন তাদের বিরুদ্ধে অনুপার্জিত আয়ের অভিযোগ সৃষ্টি হয়। সাধারণত এ জাতীয় অনৈতিক অর্থ আয়ে কোনো প্রকার ভ্যাট বা ট্যাক্স দেওয়া হয় না। যা অনুপার্জিত আয় হিসেবে পরিগণিত হয়।

এ জাতীয় অপরাধ প্রতিরোধে দুদকের সুপারিশ: শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিতকল্পে মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা মনিটরিং কমিটি গঠন করা।

সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির নীতিমালা অনুসারে বদলি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সংযুক্তির মাধ্যমে প্রশাসনিক কোনো পদে বা ঢাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদায়ন করা উচিত নয়।

গ্রামীণ বিদ্যালয়ে শিক্ষকস্বল্পতা, বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকের স্বল্পতা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

প্রশ্নপত্র আমূল সংস্কার করা প্রয়োজন: যেমন পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া। প্রশ্ন হতে পারে বর্ণনামূলক, সৃজনশীল এবং বিশ্লেষণধর্মী।

সরকার প্রণীত কোচিং নীতিমালার বাইরে যেসব শিক্ষক কোচিং করাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

কোচিং সেন্টার বন্ধ করা প্রয়োজন। এসব কোচিং সেন্টারের মালিক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের বিষয়গুলো দুদক খতিয়ে দেখবে।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সকল নোট-গাইড প্রকাশনা সংস্থায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন এবং শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির মধ্যে নিয়মিত মাসিক সভার আয়োজন করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘শিক্ষা বিষয়ে দুদক যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো অনুসরণ করা হলে আমরা একটি সুন্দর প্রজন্ম পাব। আগামি প্রজন্মের কাছে আমরা যেন ভালো কিছু রেখে যেতে পারি সেজন্যই এ চেষ্টা। এরই অংশ হিসেবে শিক্ষা খাতের দুর্নীতি রোধে আমরা নানাভাবে কাজ করছি।

আরো পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জানুয়ারি ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়