ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

সংকটের ঢালচরে জীবনের লড়াই

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সংকটের ঢালচরে জীবনের লড়াই

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার চরফ্যাশনের ঢালচর ঘুরে : নদী-ভাঙনকেই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন ঢালচরবাসী। ভাঙ্গনের ফলে দ্বীপের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। বাড়ছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা। সম্পদ হারিয়ে অনেকের ঠাঁই হয়েছে রাস্তার ধারে। দ্বীপবাসী সমস্যা তালিকার দুই নম্বরে দুর্যোগ, তিন নম্বরে যোগাযোগ, চার নম্বরে স্বাস্থ্য এবং পাঁচ নম্বরে শিক্ষা সংকটকে রাখতে চান। এসব ঘিরেই সংকটের ঢালচরে জীবনের লড়াই। দ্বীপের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে আলাপে এই চিত্র উঠে এসেছে।

ঢালচরের প্রাণকেন্দ্র সালাম হাওলাদার বাজার। সন্ধ্যা থেকে অধিক রাত অবধি বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে সামাজিক- সব ধরনের আলোচনার কেন্দ্র এই বাজার। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, আড্ডায় সময় কাটানোর স্থল হিসেবেও এই বাজার পরিচিত। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে গোটা দ্বীপ অন্ধকারে ডুবলেও বাজার আলোকিত হয় জেনারেটরের আলোয়। বাজারের একটি ভাড়া ঘরে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের কাজও চলে অধিক রাত পর্যন্ত। এখানেই আলাপ হচ্ছিল বিভিন্ন মানুষের সাথে।
 


চরের বাসিন্দারা জানালেন, ঢালচরের পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর দিকে ভাঙছে। গত ২-৩ বছর ধরে ভাঙনের তীব্রতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। শুধু বর্ষায় নয়, এখন শীতকালেও ভাঙছে নদী তীর। বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই দ্বীপের ভাঙন রোধে নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি অনুযায়ী, ক্রসড্যাম দিয়ে ভাঙন রোধ করা যায়; আবার ভাঙন এলাকায় কংক্রিট ব্লক ফেলেও ভাঙন রোধ করা সম্ভব। এ বিষয়ে বহুবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন জানানো হলেও এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র।

ঢালচরের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব তুলে ধরে বাসিন্দারা জানান, ভোলা জেলা থেকে আহরিত ইলিশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আহরিত হয় ঢালচর থেকে। এখানে চিংড়ি উৎপাদিত হয়, কাঁকড়া চাষ হয়, রয়েছে অসংখ্য গরু-মহিষ। এ থেকে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে। এসব কারণে ঢালচরকে রক্ষা করা জরুরি। এই চর রক্ষা হলে নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষেরা বাঁচার ঠিকানা পাবে। তারুয়া সমুদ্র সৈকত, পূর্ব ঢালচরের নতুন সমুদ্র সৈকত, দক্ষিণ ঢালচরে জেগে ওঠা নতুন চরের সম্ভাবনা বিকশিত হবে। দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে যে সাড়ে তিন হাজার একর খাসজমি রয়েছে, তাতে ২ হাজারের বেশি পরিবারকে পূনর্বাসন করা সম্ভব হবে।
 


নদীভাঙনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে যে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, এটাকে দ্বীপের মানুষ দুই নম্বর সমস্যা হিসেবে দেখছেন। তারা জানালেন, ভাঙনের কারণে দ্বীপে দুর্যোগের মাত্রা বেড়েছে। এখন ঘর থেকে বের হলেই কোন না কোন বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে। এখানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। একটি ছিল; সেটিতে কিছুদিন আগে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থানান্তর করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবনটি আশ্রয়কেন্দ্রের কাজে ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও সেটি নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে। আলাপে জানা গেল, দুর্যোগ প্রস্তুতিতে এখানে বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই। ৩টি মাটির কিল্লার মধ্যে আছে মাত্র একটি। সেটিও ভাঙনঝুঁকির মুখে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেলে মানুষের আশ্রয়ের কোন স্থান নেই। আশ্রয় নেওয়ার মতো বড় ভবনগুলো অনেক আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দ্বীপের অভ্যন্তরে যাতায়াতের রাস্তা নেই। বর্ষাকালে পানি বেড়ে অনেক এলাকা তলিয়ে যায়। রাস্তাঘাট নির্মাণের পাশাপাশি ঢালচরে অন্তত ৭-৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর।

দ্বীপের সমস্যার চার নম্বরে যোগাযোগ সংকট বলে মনে করেন ঢালচরের বাসিন্দারা। এ বিষয়টি যে কেউ খুব সহজেই অনুভব করতে পারেন ঢালচরে যাওয়ার সময়। চরফ্যাশনের মূল ভূ-খণ্ড চর কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে প্রতিদিন বিকাল ৩টায় একটি মাত্র ট্রলার ছাড়ে ঢালচরের উদ্দেশ্যে। গাদাগাদি করে একই ট্রলারে মানুষ, মালামাল এমনকি গবাদি পশুও আনা-নেওয়া করা হয়। এই নৌপথে একটি ছোট লঞ্চ (ট্রলারের চেয়ে সামান্য বড়) থাকলেও তা প্রায়ই বিকল থাকে। ফলে যাত্রী ভোগান্তি থেকেই যাচ্ছে। এ পথে একটি নিয়মিত লঞ্চ অথবা সী-ট্রাক চালুর দাবি জানান এলাকাবাসী।
 


বিপন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢালচরের চার নম্বর বলে দ্বীপবাসী মনে করেন। আনন্দ বাজারে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেখানে ডাক্তার ও ওষুধ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাছাড়া বড় কোন সমস্যায় এ ক্লিনিকের সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে দ্বীপের বাজারগুলোতে বেড়েছে হাতুরে ডাক্তারের দৌরাত্ম। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সাধারণ মানুষ হাতুরে ডাক্তারের ওপরই ভরসা করেন। দ্বীপে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন বহু মানুষ। নারীদের মাতৃত্বকালীন সমস্যা নিয়ে বিড়ম্বনা এখানকার নিয়মিত ঘটনা। চর এলাকায় ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা সব সময়ই বেশি থাকে। এছাড়াও গ্যাস্ট্রো লিভার, উচ্চ রক্তচাপ, সর্দি, জ্বর, শিশুদের নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগবালাই বেশি দেখা দেয়। এখানে অন্তত ৩০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল করা  জরুরি।

শিক্ষা ক্ষেত্রে ঢালচরে রয়েছে সমস্যার পাহাড়। বাড়িঘর স্থানান্তরিত হওয়ায় এবং অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কোনমতে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পরিচালনায় আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। বহু ছেলেমেয়ে প্রাথমিকের পর মাধ্যমিক শিক্ষা অব্যাহত রাখতে পারছে না। ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, নদীভাঙন রোধ করতে পারলে ঢালচরের অনেক সমস্যাই কেটে যাবে। এর পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্ষায় দ্বীপের মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। মূল-ভূখণ্ডের সঙ্গে যাতায়াত সুবিধা বাড়াতে পারলে মানুষের ভোগান্তি লাঘবের পাশাপাশি সরকারের রাজস্বের পরিমাণও বাড়বে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়