ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কালাবাদুড় ও ধলাবাদুড় গাছ

জায়েদ ফরিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৭, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কালাবাদুড় ও ধলাবাদুড় গাছ

কালাবাদুড় গাছ (Tacca chantrieri) সূত্র: what-buddha-said

জায়েদ ফরিদ : পা-পথে হাঁটছি সারি সারি ছিন্নমূল নার্সারির পাশ দিয়ে। ভ্রাম্যমাণ এসব তরুশালা, আজ আছে তো কাল নেই। হঠাৎ রাশি রাশি ফুলগাছের মধ্যে একটি গাছে চোখ আটকে গেল। গাছটিতে বাদুড়ের ডানার মতো ছড়ানো কালো রঙের ফুল, অদ্ভুত আকৃতির যা থেকে হাতখানেক লম্বা ঝুল নেমেছে অনেক। এমন কিম্ভূতকিমাকার ফুল জীবনে একবার যে দেখেছে তার ভুলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নাম জিজ্ঞাসা করাতে খুব আগ্রহ নিয়ে বললো তরু-ব্যবসায়ী, কালাবাদুড় স্যার, ধলাবাদুড়ও আছে, তবে আইজ নাই, এর শিক্ষিত নাম ‘টাকা শনকরারি’, কার্জন হলের এক স্যারে কইছেন।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে পদ্মাপাড় এলাকায় ফসল উৎপাদনের জন্য জমি শনকরারি বা শনকরালি দেয়া হয়, যা এক ধরনের সন-চুক্তি। ‘টাকা শনকরারি’ নামটি শিক্ষিতের নাম কীভাবে হলো সেই ভাবনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘টাকা শনত্রিয়ারি’ (Tacca chantrieri)। ‘টাকা’ এর মালয়েশীয় নাম, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে একে এখনো বৃষ্টিবনের জঙ্গলে পাওয়া যায়। ‘শনত্রিয়ারি’ বিরল প্রজাতি সংরক্ষক ফরাসি তরুশালার মালিক ‘শনত্রিয়ার’র নামানুসারে হয়েছে। বৈজ্ঞানিক নাম জানা থাকলে তা শুদ্ধ করে দেয়া একজন উদ্ভিদপ্রেমীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, কিন্তু সেই ফরিদপুরের লোকটাকে আমি আর কখনো খুঁজে পাইনি।

 

ধলাবাদুড় গাছ (Tacca integrifolia) সূত্র: Thompson-Morgan

যে গাছের মঞ্জরিপত্র সাদা তার নাম ধলাবাদুড়, (White bat flower) ‘টাকা ইন্টেগ্রিফোলিয়া’ (Tacca integrifolia)। তবে ধলা আর কালা ছাড়া বাদামি, মেরুন, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি রঙেও কখনো কখনো দেখা যায় বাদুড়-ফুলকে। ইংরেজিতে এর জনপ্রিয় নাম 'ব্যাট লিলি' বা 'ব্যাট ফ্লাওয়ার'। আমাদের দেশের স্থানিক ধলাবাদুড়ের যে স্ফীতকন্দ তৈরি হয় মাটির নিচে তাতে ‘বরাহ’ বা শূকরের গায়ের মতো ছোট কর্কশ রোম থাকে বলে এর নাম ‘বারাহিকন্দ’। এই কন্দ শূকরের প্রিয় খাদ্য যা খুব সহজেই শনাক্ত করতে পারে এই প্রাণী। কবিরাজি চিকিৎসায় বলকারক, পুষ্টিকর, হজমে সহায়ক, কুষ্ঠ ও চর্মরোগে এর ব্যবহার আছে। চিকিৎসা ব্যতিরেকেও এর কন্দ মানুষ খেতে পারে, তবে তা শোধন করে নিতে হয়, ছাই দিয়ে ঘষে, লবণ পানিতে জ্বাল দিয়ে। এসব দুর্ভিক্ষের খাবার, স্বাভাবিকভাবে মানুষ এত কষ্ট করে এগুলো কখনো খায় না। একই ‘ইয়াম’ বা ‘ডায়স্কোরিয়া’ পরিবারের মেটেআলু, খামআলু (Dioscorea alata) ও সুষণিআলু (Dioscorea esculenta) এর চেয়ে সুস্বাদু যা এখনো উপমহাদেশের গ্রামাঞ্চলসমূহে খাওয়ার চল আছে।

কালাবাদুড় গাছে স্বাভাবিকভাবে যাকে পাপড়ি বলে ভ্রম হয় তা আদতে বাদুড়-ডানার আকৃতির কালো রঙের দুটো মঞ্জরিপত্র। এর ফুল ক্ষুদ্রাকার, কাপের মধ্যে থাকে। অদ্ভুত আকারের যে সূত্রাকার ঝুল নামে গাছ থেকে সেগুলোও মঞ্জরিপত্রের পরিবর্তিত রূপ। এর পাতা দেখতে পিস-লিলির মতো চকচকে, ২-৩ ফুট লম্বা হয়, তবে সাদাবাদুড় গাছ ৪ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। বাদুড় গাছ বৃষ্টিবনের নিচের স্তবকের গাছ যেখানে রৌদ্রালোক কম, জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন প্রভৃতি এলাকায় এদের আদিবাস। তবে ভারত-বাংলাদেশেও কিছু দেখা যায়।

বাদুড়গাছের গুচ্ছ ফুল, সূত্র: flowers by GardenTags

বাদুড়গাছ জন্মানোর জন্য বৃষ্টিপাত, বায়ুর আর্দ্রতা, উষ্ণতা ছাড়াও হাওয়া চলাচল ও ছায়া দরকার হয়। এতগুলো শর্ত পূরণ হওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশেই সম্ভব। বর্তমানে আবদ্ধ গ্রিনহাউসে একে জন্মানো বেশ কষ্টকর, বিশেষত হাওয়া চলাচল কমতির জন্য। যারা টবে এর উৎপাদন করেন তাদের জল সরবরাহের দিকে নজর রাখতে হয় যাতে ভালমত গাছের গোড়া না শুকোলে জল না দেয়া হয়। বাদুড় গাছের যত্ন অনেকটাই অর্কিডের মতো। আধাআধি পিট্মস ও নারকেলের ছোবড়ার সঙ্গে ১০ শতাংশ বালি মিশিয়ে এর মাটি প্রস্তুত করতে হয়। অনেকে টবের নিচে একটি জলধারণকারী থালা রাখেন যাতে গাছ অতিরিক্ত ভেজা না থাকে আবার শুকিয়েও না যায়।

এই গাছের পরাগায়ন নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। মঞ্জরীপত্র দেখে আকৃষ্ট হয় পরাগায়নকারী পোকা যার বেশিরভাগই মাছি। মঞ্জরি-ঝুলগুলো বাতাসে দোল খেয়ে মাছিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ঝুলের উপরে বসার পর মাছি সূত্র বরাবর হেঁটে ফুলের দিকে চলে যায়। ফুল থেকে উৎসারিত পচা গন্ধে মাছিরা আকৃষ্ট হয়ে পরপরাগায়ন করে বলে আমাদের ধারণা এতকাল বদ্ধমূল ছিল। কিন্তু গবেষণাক্ষেত্রে দেখা গেছে, মঞ্জরিপত্র এবং ঝুলগুলো কেটে ফেলার পরও পরাগায়নে তেমন একটা উন্নতি হয়নি। এর কারণ এই গাছে আপনা থেকে স্বপরাগায়ন হয়, এমনকি ফুল ফোটার আগে ভিতরেই গর্ভমুন্ডে পরাগ লেগে যায়। এই আবদ্ধ পরাগরেণুকে গতিশীল করে গর্ভমুন্ডে স্থানান্তর করার জন্য হয়ত জোর বাতাসের ভূমিকা আছে। এই গাছ যেখানে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ বেশি থাকে সেখানেই জন্মায়। এই তথ্য আমেরিকান জার্নাল অব বটানিতে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফল। কিন্তু মঞ্জরিপত্র (Bracts) ও মঞ্জরি-ঝুলের (Bracteoles) বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি জানতে পারেননি।

একক বাদুড় ফুল, সূত্র: Jerry Coleby-Williams

বাদুড়গাছ বহুবর্ষজীবী, জীবনচক্র শেষ হয় দুই বছরে। ফল থেকে সৃষ্ট বীজ পুষ্ট হতে সময় লাগে দেড় বছর, এরপর মাটিতে এর অঙ্কুরোদগমের জন্য প্রয়োজন হয় আরো একবছর। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা না করে দ্রুত বিস্তারের জন্য এর রাইজোম থেকে চারা তৈরি করা হয়। বাদুড় গাছ বেশ কিছু দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু চীনের ইউনান প্রভিন্সে এখনো বেশ দেখা যায়। একটি গাছে গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত পর্যন্ত আট-দশবার ফুল ফোটে। এই গাছ প্রকৃতিতেই সুন্দর, একে কেটে নিয়ে কাট-ফ্লাওয়ার উপহার দেয়া বা ঘরে রাখা যায় না, কারণ এটা খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। খ্রিস্টীয় হ্যালোইন অনুষ্ঠানের সময় বাদুড় ফুল ফুটতে দেখা যায়, কেউ যদি এ সময় কাউকে এই ফুল উপহার দিতে চায় তবে সাধারণত টবসহ দিয়ে দেয়।

লেখক: প্রকৌশলী এবং উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ



রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ১৮ ফেব্রেুয়ারি ২০১৮/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়