ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

অস্ত্রে উত্থান, অস্ত্রেই পতন, কেউ আত্মসমর্পণ করে পাগল

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ১৯ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অস্ত্রে উত্থান, অস্ত্রেই পতন, কেউ আত্মসমর্পণ করে পাগল

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : অস্ত্র হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে এক একজন হয়ে উঠেছিলেন ভয়ঙ্কর দস্যু! সামান্য সদস্য থেকে বাহিনীর নেতা। এক দস্যু বাহিনী আরেক বাহিনীকে হটাতে গিয়ে মেতেছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। অস্ত্রে যাদের উত্থান হয়েছে, অস্ত্রেই পতন ঘটেছে তাদের।

চারদিকে নদীবেষ্টিত চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচর এবং এর আশপাশের জনপদে কান পাতলে শোনা যায় এমন নানান গল্প। জানা যায়, কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ দস্যু হয়ে উঠেছিলেন, কীভাবেই বা তাদের পতন ঘটেছে। দস্যু আমলের শিহরণ জাগানো ঘটনাগুলো মনে করতেও ভয় পান এলাকার মানুষ। এখন ভয় নেই; কিন্তু ভয়ঙ্কর সেই গল্পগুলো রয়ে গেছে। উড়িরচরের যে বাজারগুলোতে বসে দস্যুদের গল্পগুলো এলাকাবাসী বলেছেন, সেসব স্থানে এক সময় দ্বীপবাসীর চলাচলের সাহস ছিল না। বাজারের দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে অস্ত্র রেখে প্রভাব বিস্তার করেছে তারা। অস্ত্র হাতে বাহিনীর লোকজনের চলাচল দেখে সর্বক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত থাকতো মানুষ। কৃষক জমিতে আবাদ করলেও ফসল তোলার নিশ্চয়তা ছিল না। অর্থ সম্পদশালী মানুষদের জিম্মী করে অর্থ আদায় করতো দস্যুরা। 

এলাকার মানুষ জানান, বাহিনী প্রধানের কোনো মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করে নিয়ে যেত। নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ছিল অহরহ। মায়ের সামনে ধর্ষণ করা হয়েছে মেয়েকে-এমন ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে চাকরিরত এক পরিবারের দুই বোন বাড়িতে বেড়াতে এলে নজর পড়ে দস্যু বাহিনীর। মায়ের সামনেই ওই দুই বোনকে ধর্ষণ করে বাহিনীর সদস্যরা।   

এককালে উড়িরচরের বন আর চরাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ানো সেই ‘ভয়ঙ্কর’ মানুষগুলোর কারও অস্ত্রে পতন ঘটেছে; কেউবা আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ঘরে ফিরেছে। জীবনের বড় সময়টা দস্যুতায় কাটিয়ে এখন তারা স্বাভাবিক জীবন বেছে নিয়েছে। কেউ কেউ পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সমাজে মিশে যেতে পারলেও অনেকের মস্তিষ্ক বিকৃতিও ঘটেছে। অসংখ্য মামলার প্রচীর ভেদ করে এসে এই মানুষেরা এখন যেন পথ হারানো পথিক।

উড়িরচর নিয়ন্ত্রণকারী দস্যু বাহিনীর নেতাদের মধ্যে নিজাম ডাকাত, শাহাদাত হোসেন জাসু, ইব্রাহিম মাঝিসহ আরও বেশকিছু দস্যু বাহিনীর সদস্য অভিযানকালে গোলাগুলিতে প্রাণ হারান। উড়িরচরে দস্যু নেতা জাসুর সেই বাড়িটি যেন নীরবে ঘুমিয়ে আছে। যে বাড়িটি সর্বক্ষণ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে উত্তপ্ত থাকতো, বাড়ির সামনে দিয়ে মানুষ হেঁটে যেতে সাহস পেত না, সে বাড়িটি এখন নীরব, স্তব্ধ। জীবনের একটা বড় সময় দস্যুতায় কাটানো মানুষগুলোর জীবনচিত্রের বিবরণ মেলে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এইসব গ্রামের কাছেই ছিল ঘন বনে ঘেড়া  বিচ্ছিন্ন জনপদ উড়িরচর। আর সেখানেই দস্যুতা চলতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। বাবার সঙ্গে ছেলে, চাচার সঙ্গে ভাতিজা, বড় ভাইয়ের সঙ্গে ছোট ভাই দস্যু বাহিনীতে যোগ দিত।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে উড়িরচর থেকে নোয়াখালীর মুছাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ইউনিয়নের ছোট ফেনী নদীর তীরে রেগুলেটর এলাকায় ছিল ঘন বন। ওপারে দুর্গম উড়িরচর। এই গোটা এলাকায় দস্যু বাহিনীর রাজত্ব ছিল। চাষিদের গরু-মহিষ নিয়ে যাওয়া, পাকা ধান লুট, লোকজন ধরে নিয়ে যাওয়া, জেলেদের আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো  অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এইসব বাহিনী।

মুছাপুর ইউনিয়নের রেগুলেটর এলাকার যে স্থানে বসে মানুষের সঙ্গে কথা বলি, সেখানে বলতে গেলে মানুষজন যাতায়াতই করতে পারতেন না। দিনের আলোতেও ভয় ছিল দস্যুদের। এমনকি এখানে রেগুলেটর প্রকল্পের কাজ শুরু করতে এসেও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের লোকজন দস্যুদের মুখোমুখি হয়েছেন। হুমকির মুখে পড়ে চাঁদা দিতে হয়েছে। মুছাপুরে জানা যায়, দস্যুদের একটি অংশ অন্ধকার জীবন ছেড়ে আলোয় ফিরেছেন। কীভাবে তারা ত্যাগ করেছেন সেই জীবন? স্বাভাবিক জীবনে ফেরা দস্যু, তাদের স্বজন কিংবা এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা করে এ বিষয়ে নানান তথ্য মেলে।
 


জাহাঙ্গীর আলম। বয়স ত্রিশের কোঠায়। অতি অল্প বয়সে নিজের আপন চাচা আবসার বাহিনীতে যোগ দেন। তখন বয়স মাত্র ১৯-২০ বছর। বাহিনীর অধীনে চাষিদের জমিজমা দখল, ধান লুটসহ বিভিন্ন কাজে নেতৃত্ব দিতেন জাহাঙ্গীর। তার কাছে ছিল অস্ত্র। চুরি, ডাকাতি, গরু ছিনতাই, পুলিশ ফাঁড়ি ভাংচুরসহ বিভিন্ন ঘটনায় ২০-২৫টি মামলা হয় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। এক সময় নিজেই বাহিনী থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। অবশেষে ২০০৮ সালে ফেরেন স্বাভাবিক জীবনে। স্ত্রী আর এক কন্যা নিয়ে তার বসবাস মুছাপুর ইউনিয়নের ৭ নাম্বার ওয়ার্ডে। রেগুলেটর এলাকায় একটি ছোট্ট দোকান দিয়েছেন তিনি।

তছির আহমদ। দস্যু বাহিনীর এক বড় নেতা। নিজের নামেই ছিল বাহিনীর নাম। তছির মাঝি নামে তার পরিচিতি। বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০-৩৫ জন। বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে আত্মগোপনের জন্য চল্লিশ বছর বয়সে দস্যু বাহিনীতে যোগ দেন। নানান অপরাধের মধ্যে তার অন্যতম কাজ ছিল ট্রলারের মাছ লুটপাট। ১৪টি মামলায় হাজিরা দিতে দিতে এক পর্যায়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। তবে অত্যাচার নির্যাতনে তিনি এখন অনেকটাই মস্তিষ্ক বিকৃত।

আবছার মেম্বার। ১৯৯৯ সাল থেকে দস্যু বাহিনীর দলে। নিজেই বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন বলে নিজের নামেই বাহিনী। দলে ছিল ৫০-৬০ জন সদস্য। নদীতে ডাকাতি করে এই বাহিনীর সদস্যরা রেগুলেটর এলাকার বাগান বাড়ির আস্তানায় আশ্রয় নিতেন। একবার দলে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে বাহিনী প্রধান আবছার গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুশয্যায় চলে যায়। পুলিশ তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় গ্রেফতার করে। তিন বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পাগলপ্রায় অবস্থায় স্বজনদের কাছে ফেরেন।

ভুট্টো। বাড়ি চর ফকিরা ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামে। নিজের নামেই ছিল বাহিনীর নাম। আস্তানা ছিল কোম্পানীগঞ্জের উড়িরচর এলাকায়। বর্তমানে দাপটশালী জাসু বাহিনীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই উড়িরচর থেকেই যৌথবাহিনীর এক অভিযানে ধরা পড়ে ভুট্টো। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দস্যু বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। জেল থেকে বের হওয়ার আগেই এই পথ ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। ২০১১ সালে ফেরেন স্বাভাবিক জীবনে।

হাশেম মাঝি। নিজের নামে গড়া তার বাহিনীতে সদস্য ছিল শতাধিক। আধিপত্য ছিল চর হাজারী এলাকায়। নিজের ট্রলার ছিল। বাহিনীর তৎপরতা ছিল নদীপথে। মহিষ-ভেড়া ও জেলেদের নৌকায় হামলা করতো। মুক্তিপণ আদায় করতো। ২০০৯ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারের পর তাকে ক্রসফায়ারে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে দেয়া হয়নি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের সেই কলঙ্কিত ট্রলারটি বিক্রি করে ওমরাহ হজ্জ পালন করেন। সেই থেকেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। 

নেয়ামত। রেগুলেটর এলাকায় টিপু বাহিনীর পরে নেয়ামত বাহিনী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিত। এলাকায় গরু-মহিষ, ধান এমনকি বাড়িঘর লুট করে ট্রলারে তুলে নিয়ে যেত। ২০১৩ সালে গোপন সূত্রের খবরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পায়ে গুলি করে নেয়ামতকে গ্রেফতার করে। কেটে ফেলতে হয়েছে তার গুলিবিদ্ধ পা। অন্যদিকে তার বাহিনীতে থাকা দস্যুরা দলছুট হয়ে গেছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়