ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

স্মরণ || বিপ্লবী সূর্য সেন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২২ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মরণ || বিপ্লবী সূর্য সেন

শাহ মতিন টিপু : সূর্য সেন। আমাদের স্বাধীনতার প্রতীকী মাস মার্চেই এই মহান বিপ্লবীর জন্ম। ১৯৩৪ সালে মৃত্যুর আগেও সঙ্গীদের বলে যান তার ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’র কথা।

ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার এটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’

সূর্য সেনের আরেকটি পরিচয় ‘মাস্টারদা’। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিতি পান। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় সূর্য সেনের জন্ম।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ভোর ১২টা ৩০মিনিটে বীর বিপ্লবী সূর্যকুমার সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় চট্টগ্রাম কারাগারে কার্যকর হয়। বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুই নায়কের মৃত দেহ বস্তাবন্দি করে জাহাজে করে নিয়ে গিয়ে পাথর বেঁধে বঙ্গোপসাগরের অতল জলে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। বাংলার মাটিতে কোথাও যেন তার চিহ্ন না থাকে। অথচ তার দেখানো পথটি ধরেই বছরের পর বছর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এ দেশের মানুষ।

প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন বেঙ্গল আর্মড পুলিশের সদস্য পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের নুর মোহাম্মদ এক বেতার সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে ক্রুজারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মরদেহ দুটি তার ডেকে সূর্য সেনের লাশের বুকে জনৈক হিকস সাহেব লাথি মেরে উল্লাস প্রকাশ করছিলেন।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেনের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি বৃটিশ ভারতের চট্টগ্রামে এক বিদ্রোহ সংঘটিত করে। এই বিদ্রোহীরা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করে, পুলিশ ও অক্সিলিয়ারি ফোর্স অস্ত্রাগার অধিকার করে স্বাধীন বিপ্লবী সাময়িক সরকার গঠন করে এবং এই সরকারকে সমর্থন করার জন্য জনসাধারণের নিকট আহ্বান জানান। পরাক্রমশালী ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বার জন বিপ্লবী শহীদ হন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বীরযোদ্ধা ছিলেন সূর্য সেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখের সঙ্গে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করেন। গান্ধীজী কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময় চট্টগ্রাম গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ভাগ হওয়ার পর কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দেওয়া অংশের সভাপতি ছিলেন সূর্য সেন।

মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর সূর্য সেনের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা প্রকাশ্যে সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া টাকা ছিনতাই করে। এর পর পুলিশ বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের খন্ড যুদ্ধ হয় যা ‘নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান।

১৯২৬-এ টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টায় আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯২৮ সালে ছাড়া পান। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের কয়েকদিন পর ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে বিপ্লবীদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।

এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী সাময়িকভাবে পলায়ন করে যা ছিল দেড়শত বছরের মধ্যে ইংরেজ বাহিনীর এদেশের মানুষের কাছে প্রথম সুস্পষ্ট পরাজয়। তাই এই যুদ্ধের ঐতিহাসিক মূল্য অনেক।

১৮ এপ্রিলের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার, দামপাড়ার পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখলে আসে বিপ্লবীদের। এই আক্রমনে অংশ নেয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্যসেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। সূর্যসেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়।

১৮ এপ্রিলের (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের দিন) অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ঐ ক্লাবে কেউ ছিল না। মাস্টার’দা সূর্যসেন স্থির করেন ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৩২ সাল) প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। ২৩ সেপ্টেম্বর রাতের এই হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। কিন্তু গুলিতে আহত প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। সূর্য সেন গ্রেফতার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ১৮ মে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারির সাথে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন।

সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৪ আগষ্ট ১৯৩৩ সালে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায় প্রদানের পর তিনজন বিপ্লবীর পক্ষে কলকাতা হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করা হয়। ১৪ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দন্ড বহাল রাখে। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর হয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়