ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলের পথে

বাঁধ হচ্ছে, হাজারো মানুষ ঘরছাড়া!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৬, ২৩ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঁধ হচ্ছে, হাজারো মানুষ ঘরছাড়া!

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের বাউরিয়া ঘুরে : নদীর ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছিল বেড়িবাঁধে। কেউ ৩০ বছর, কেউ ৩৫ বছর, কেউবা ৪০ বছর ধরে বসবাস করছিল বাঁধের ধারেই।

শুধু বসতবাড়ি নয়; ছিল দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গবাদিপশুর খামারসহ আরো অনেক কিছু। পুরোনো বাড়িগুলো ঘিরেছিল সবুজ গাছপালা। ভাসমান মানুষ হিসেবে বাঁধে আশ্রয় নিলেও এরা ভোটার হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদকে ট্যাক্স দিয়েই ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে এদের ঠিকানার স্থানে লেখা রয়েছে ‘বাউরিয়া বেড়িপাড়’। তবুও সেই বাড়িটি ছেড়ে দিতে হয়েছে। বেড়িবাঁধে বসবাসকারী হাজারো পরিবার এখন পাশের ফসলি মাঠে আশ্রয় নিয়েছে। 
 


চিত্রটা চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বাউরিয়া ইউনিয়নের বাউরিয়া বেড়িবাঁধ এলাকার। সন্দ্বীপের চারিদিকে বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় বাউরিয়া-সন্তোষপুর এলাকায় এখন এই কাজ চলছে। সন্তোষপুর থেকে বাউরিয়া পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে প্রায় ৪ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ এখন পথে বসেছে। নতুন বাড়ি করার সুযোগ না পেয়ে এদের অনেকেই এখন ফসলি জমিতে ঝুঁপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছে।

বাসিন্দারা জানালেন, মাত্র ১৫ দিনের নোটিশে বেড়িবাঁধের বাড়িগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। নোটিশ পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ এলাকার সংসদ সদস্যের সঙ্গে দেখা করে উচ্ছেদ নোটিশ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালেও এদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
 


পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি জমিতে এত বছর ধরে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন সরকারি উন্নয়ন কাজের প্রয়োজনে বাঁধের বাসিন্দাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে। এজন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ নেই। 

প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাগরের করাল গ্রাসের হাত থেকে সন্দ্বীপকে রক্ষায় প্রায় ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সন্দ্বীপের চারিদিকে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ উঁচু করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সন্দ্বীপ স্থায়ীভাবে ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে রক্ষা হবে সন্দ্বীপের সম্পদ। তবে এই বাঁধ পুনঃনির্মাণের ফলে সন্দ্বীপের ৩ লক্ষাধিক মানুষ উপকৃত হলেও বাঁধে বসবাসকারী অন্তত এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 
    


বেড়িবাঁধের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এক একটি পরিবার ৪-পাঁচ বার নদীভাঙনের শিকার হয়ে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। প্রথমদিকে আসা পরিবারগুলো প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁধে বসবাস করছে। নিঃস্ব মানুষদের অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগ হিসেবে খুঁজে নিয়েছে দিন মজুরির কাজ। এদের পক্ষে অন্য কোথাও বাড়ি করাও সম্ভব হচ্ছে না। 

ওদিকে এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আকস্মিকভাবে একসঙ্গে এতগুলো পরিবার উচ্ছেদ করার ফলে এলাকায় জমির দামও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। আগে এক শতক জমি ১৪, ১৬ কিংবা ২০ হাজার টাকায় পাওয়া গেলেও এর মূল্য এখন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। একদিকে বাঁধ হচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ আসার খবরে এলাকায় জমির মালিকেরা জমির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। 

বাঁধের বাসিন্দারা বলেছেন, আমরা সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে চাই। কিন্তু আমাদেরও সরকারের কাছে দাবি আছে। নদীভাঙনে সব হারিয়ে আমরা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখন আমরা কোথায় যাব? আমরা এদেশেরই নাগরিক। ভোটার তালিকায় আমাদের নাম আছে, জাতীয় পরিচয়পত্রে আমাদের ঠিকানা বেড়িপাড়। আমরা নাগরিক হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদকে ট্যাক্স দেই, বাঁধের ওপরে থাকা দোকানগুলোর ট্রেড লাইসেন্সও আছে। আমরা সরকারের কাছে মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই।
 


রেজমিনে বাউরিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় মানবিক বিপর্যয়ের দৃশ্য চোখে পড়ে। বেড়িবাঁধ থেকে বাড়িঘর সরিয়ে বাসিন্দারা ঝুঁপড়ি ঘর বানিয়েছেন পাশের ফসলি জমিতে। সামর্থ্য আছে, এমন সামান্য কিছু পরিবার জমি কিনে অন্যত্র ঘর তৈরি করতে পারলেও অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয়নি। ফসলি জমির মালিকদের অনুমতি নিয়ে অল্প ক’দিনের জন্যে অনেকেই অস্থায়ীভাবে ঠাঁই নিয়েছে। জমির মালিকেরা তাদের জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলছে। এ অবস্থায় বাসিন্দারা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সামনেই সমাগত বর্ষায় এই ফসলি জমি পানিতে ডুবে যাবে; তখন দুর্ভোগ আরো বাড়বে। 

বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। থাকার ঘর এলোমেলো, রান্না ঘর নেই, টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই। দুই চালা একত্রিত করে অনেকে ঘর বানিয়েছেন। আবার অনেকের ঘরে বেড়া থাকলেও নেই চালা। অনেকে আবার ছোট শিশুদের নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। এরপর এই সংকট মোকাবিলা করে পরিবারগুলোকে রোজগারের চিন্তাও করতে হচ্ছে। সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে নারী-পুরুষ ও শিশুরা তাদের দুর্ভোগের খবর জানাতে ছুটে আসেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে এক একজন বলে ওঠেন, আমাদের কী অপরাধ? আমরা তো এদেশেরই নাগরিক। উন্নয়ন কাজ করুন, আমাদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন। অনেক খাসজমি আছে, সেখানে আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন।
 


বেড়িবাঁধ ছেড়ে খোলা মাঠে আশ্রয় নেওয়া আবুল কাসেম বলেন, আমরা এই দেশের নাগরিক হয়ে যেন রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ হয়ে গেছি। আমাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেড়িবাঁধ ছাড়তে বলা হলো। আমরা এখন যাব কোথায়?

বাঁধের মানুষের বিপন্ন অবস্থা দেখতে দেখেতেই দেখা হলো বাউরিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই মানুষগুলো বেড়িবাঁধে ছিল। কিন্তু এখন সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে তাদের বেড়িবাঁধ ছাড়তে হচ্ছে। এদের জন্য পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।     

                    

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৮/রফিকুল ইসলাম মন্টু/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়