ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হাইব্রিড বাঙালির পান্তাপ্রীতি

অরুণ কুমার বিশ্বাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১৪ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাইব্রিড বাঙালির পান্তাপ্রীতি

অরুণ কুমার বিশ্বাস : ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত, থুক্কু পহেলা বৈশাখ। আমের মুকুল বড় হয়ে এখন আম্রশাখে দোদুল্যমান গাঢ় সবুজ আম। অথচ সেদিকে কারো মনোযোগ নেই, মাছির মতো সবাই জেঁকে বসেছে মাছের বাজারে। বাঙালি হবার প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে সকলে। ইলিশ চাই ইলিশ, সাথে দুদিনের বাসি পান্তা। জাটকা খেতে খেতে যার কিনা জিভ পঁচে গেছে, তারও আজ ইলিশ খাওয়া চাই। বৈশাখের প্রথম প্রহরে যুতসই পান্তা, পোড়া মরিচ আর ইলিশ না পেলে কিসের বাঙালি!

নকিব সাহেব বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। পারতপক্ষে তিনি ভাতটাত ছুঁয়ে দেখেন না, পিৎজা-পাস্তায় তার বেজায় আস্বাদ। বাসার খাবার তার মুখে রোচেনা। তবে কি তিনি রাস্তায় খান! জি হ্যাঁ, বিজনেস ম্যাগনেট নকিব পাঁচতারকার খাবার গাণ্ডে-পিণ্ডে গেলেন। কিন্তু ছেলেপুলেরা বায়না ধরেছে, পহেলা বৈশাখে তাদের দেশি পোশাকাদি, সেই সাথে খাঁটি পান্তাভাত চাই।

সত্যি বলতে, পান্তা কী জিনিস নকিব জানেন না। তাও আবার খাঁটি পান্তাভাত! এই জামানায় কোন জিনিসটা খাঁটি বলুন? বিষ খেয়ে এখন ইঁদুর তো ভালো, মানুষও মরে না। তিলোত্তমা শহর ঢাকায় ভেজালের ছড়াছড়ি। ছেলের বায়না শুনে ভিরমি খান নকিব। তার সম্মুখে বিষম বিপদ সমুপস্থিত। পান্তা তিনি কোথায় পান! পান্তা মানেই বা কী! ছোটকালে শুনেছেন বাগবিধি-পান্তা ভাতে ঘি। মানে অকারণ উৎকৃষ্ট জিনিসের অপচয়। বাংলা একাডেমি অভিধান খুলে দেখেন, পান্তা মানে পানিতে ভেজানো বাসিভাত।বাসি মানে পঁচা ভাত! ওয়াক! নকিব সাহেবের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এমনই ছিল। বিবমিষা। তিনি বাচ্চাদের বোঝান, বাসি জিনিস ভালো নয়। খেলে পেটের পীড়া হবে। তা হোক, তাও বাঙালি হিসেবে একবেলা পান্তা খাওয়া খুব দরকার। নইলে মানুষ কী ভাববে বলো তো!

দিনভর ফাস্টফুড সাঁটানো পোল্ট্রি মুরগি সাইজ বাচ্চারা সব একাট্টা হলো-পান্তা আনো পান্তা চাই। নইলে মোরা বাঙালি নাই। নকিব মহা বেকায়দায় ফেঁসে গেলেন। ফাইভ-স্টারে নানাবিধ খাবার মেলে, কিন্তু পান্তা আছে কিনা জানা নেই। একজন বুদ্ধি দিলো, আপনি কষ্ট করে ফুটপাতে মন দিন। ওখানে যেসব ছিন্নমূল মানুষ থাকে, তারা নিত্য দুবেলা পান্তা খায়। তাদের পেটের অসুখ হয় না। না উদরাময়, না ওলাওঠা।

বেশ বেশ! খুশি মনে নকিব চলে যান রমনা পার্ক লাগোয়া ঝুপড়িতে। সেখানে মাটির মালসায় বাসি ডাল দিয়ে হাপুস হুপুস করে পান্তা খাচ্ছে ওরা। যেন এরচে সুস্বাদু খাবার আর নেই। পিলপিলে বাচ্চার নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে,  মা আদর করে মুছিয়ে দিচ্ছে। একজনের দাঁতে শক্ত কিছু আটকেছে, মা তার শতচ্ছিন্ন শাড়ির আঁচল দিয়ে পরিষ্কার করছে। জীবনের কী অপার সমারোহ এখানে! হোক না পান্তা বা বাসি ডাল, কত পরিতৃপ্তি নিয়ে এরা খাচ্ছে!

আপনার কাছে একটু পান্তা হবে? কাল সকালে? দ্বিধা-সঙ্কোচ ভুলে শেষমেশ বলেই ফেলেন নকিব সাহেব।

মহিলা ভাবলেন, সায়েব নিশ্চয়ই তার সাথে মশকরা করছে! এমন সুটেড-বুটেড-টাইড মানুষ নাকি পান্তা খাবে! এর কাছে পাত্তা না পেয়ে অন্যত্র পান্তার খোঁজ করেন নকিব। এরা কি আর জানে, মিস্টার নকিব ও তার ফ্যামিলি অন্তত একদিনের জন্য ‘খাঁটি বাঙালি’ হতে চান।

মনেপ্রাণে বাঙালি! কভি নেহি। নকিব স্বগতোক্তি করেন, তার পরিচিত এমন কে আছে যার কিনা দেশের বাইরে সেকেন্ড হোম নেই! মুখে যারা বড় বড় কথা বলে, তাদের কার ছেলেপুলে বিদেশে পড়ালেখা করছে না? যারা শত মুখে দেশপ্রেমের বুলি ঝাড়ে, তলে তলে এদের কার না বিদেশি কোম্পানির সাথে আঁতাত আছে? বিশিষ্টজনেরা বলেন বাঙালি হতে হলে শুদ্ধ করে বাংলা বলা চাই। বললেই হলো! নাক সিঁটকান নকিব। এই তো সেদিন সাক্ষাতকারে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে দুচারটে চোস্ত ইংরেজি শব্দ আওড়াতে না পারায় অমুকের চাকরিটা হলো না! আমরা সব ভাতে ও ভাবে বাঙালি, মনোভাবে নয়। ইলিশ না হয় বাজারে মেলে, পান্তাও ধরুন বাসি পানিতে ভিজিয়ে বানানো গেল, কিন্তু খাঁটি বাঙালি কী করে হবেন? বছরে একদিন দেশি পণ্য পরে আর সেজেগুঁজে রাস্তায় নামলেই কি বাঙালি হওয়া যায়! কিংবা ধরুন সফেদ পোশাক পরে ছবিয়ালের ক্যামেরার সামনে পোজ দিলেই তো আর বাঙালিত্ব অর্জন করা যায় না।

সে যাক গে, রম্যে বড্ড সিরিয়াস ভাব এসে গেল। নকিব সাহেব অনেক কষ্ট-কসরত করে পান্তা তৈরির রেসিপি মুখস্থ করলেন। কিন্তু পান্তা হলেই হলো না, খাবার গ্রহণ ও পরিবেশনেরও কিছু নিয়ম-নীতি আছে। মেঝেতে পাত পেড়ে হাঁটু গেড়ে বসা চাই। পান্তায় বাসি বাসি চোঁয়া গন্ধটা না এলে পুরো কষ্টই মাটি। দেশের মাটিতে যেমন থাকে স্যাঁতসেঁতে সোঁদা গন্ধ। যে সে পিঁড়ি হলে হবে না, খাঁটি কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে বসা চাই। একটু খেয়াল করে দেখবেন বিড়ি কিন্তু সবার মুখে মানায় না। পিঁড়িও তেমনি, পরনের কাপড় গুটিয়ে মউজ করে বসতে হয়।

বসলেন ভালো, এবার পান্তা খাবেন। সাথে কাশি-ওঠা পোড়ামরিচ, যা কিনা এক গ্রাস পান্তার সাথে মুখে দিলেই বাঙালি বাঙালি ভাব চলে আসে। খাবেন কিসে? মানে আমি বাসনের কথা বলছি। দামি চিনেমাটি বা পোরসিলিন প্লেট হলে হবে না, খাঁটি মাটির মালসা হতে হবে। রঙটা ইট লাল হলে ভালো, তবে সোনালি হতে পারবে না। কখনওই যেন মনে না হয়, আপনি সমাজের উঁচু তলার মানুষ, বিশিষ্ট কেষ্টবিষ্টু। খাঁটি বাঙালির অহঙ্কার থাকতে নেই।

মালসায় গেল রাতে ভিজিয়ে রাখা গন্ধঅলা পান্তার সাথে একটু ডালভর্তা বা বেগুন, খানিক জাটকা বা ইলিশ ভাজা আর পোড়ামরিচ খেতে খেতে মামুলি ঘরকন্যার কথা বলবেন। ভিটেমাটির আলাপ, কিষাণ-কামলার খোঁজখবর, এই তো জীবন। আসল বাঙালি। শহুরে বাঙালি বলে একটা কথা আছে-এরা নাকি হাইব্রিড। ওই যে শুধু ভাবেই বাঙালি, মনে প্রাণে নয়। এসব কেতাদুরস্ত নোক্তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বৈশাখে মাত্র একদিন বাঙালিত্বের চর্চা করে আর কী হবে বলুন, তারচে’ আসুন আমরা আত্মবীক্ষণে নিবিষ্ট হই। বাঙালি বলে নিজের পরিচয় তুলে ধরি বিশ্বের বুকে। বুক ঠুকে বলি আমরা বাঙালি, মনেপ্রাণে-সারা বছর।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়