ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

হাইমচরের হারানো ঠিকানার খোঁজে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১০ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাইমচরের হারানো ঠিকানার খোঁজে

রফিকুল ইসলাম মন্টু, চাঁদপুরের হাইমচর ঘুরে : ঠিকানা হারিয়েছে হাইমচর; স্থানান্তরিত হয়েছে মানুষ। জনপদের ঠিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঘরবাড়ি বদলায়। জাতীয় পরিচয়পত্রে ওঠে নতুন ঠিকানা। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ভেঙে চলে মেঘনা। ভিটা হারানো মানুষ ছুঁটে চলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে। বাপদাদার শূন্য ভিটার শেষটুকু নদীর তলে হারানোর দৃশ্য দেখে বুক ভাড়ি হয় স্বজনদের। শেষটুকু নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত মাটি আঁকড়ে থাকেন তারা। কালের ধারায় মানুষগুলো ক্রমেই নিঃস্ব হতে থাকে। ব্যবসা বাণিজ্যে কিছু মানুষের অবস্থা বদলালেও সে সংখ্যা হাতে গোনা।

এটা হাইমচরের গল্প। চাঁদপুরের মেঘনার গা ঘেঁষে জেগে থাকা সেই পুরনো হাইমচর হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। বছরে বছরে ক্রমেই ছোট হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এ জনপদ। উপজেলা পরিষদ ভবন, সামান্য পরিমাণ পাকা সড়ক, গুটিকয়েক বাড়িঘর, কিছু গাছপালা অবশিষ্ট থাকলেও সেগুলো হারাতেও বেশি সময় লাগেনি। হাইমচরের শেষ ভূ-খণ্ডটুকু হারানোর আগেই হাজারো মানুষের ঠিকানা হয় রাস্তার ধারে, খাসজমিতে, নদীর পাড়ে। কেউবা চলে যায় এলাকা ছেড়ে। বিপরীতে মেঘনার বুক চিড়ে জেগে ওঠে আরেক জনপদ। নাম একই; হাইমচর।

হাইমচরের বাড়িঘর হারানো মানুষেরা ছুটে চলেন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। ঘাস আর বনজঙ্গলে ভরা নতুন চরে আসতে থাকে মানুষ। তখনও দ্বীপের মাটি শক্ত হয়নি; তবুও নিরূপায় মানুষের বসতি গড়তে হয়েছে সেখানেই। প্রায় ৩০ বছর বয়সী দ্বীপে বসতি শুরু হয় প্রায় ২০-২২ বছর আগে থেকে। সব হারানো নিরূপায় মানুষজন বাপদাদার ভিটার সন্ধানে ছুটে আসেন এখানে। ছড়ানো ছিটানো বসতি গড়ে। দলবদ্ধ মানুষ গড়ে তোলে এক একটি পাড়া। যেমনটা ছিল পুরনো হাইমচরে। নতুন হাইমচরের গোলদারকান্দিতে নিজ বাড়ির পাশে দেখা হয়েছিল ছিটু মিয়া খালাসীর সঙ্গে। অন্য কাজের ব্যস্ততায় তার সাথে আলাপ হয়নি। পরের দিন যাই তার বাড়িতে। বিধ্বস্ত-বিপন্ন কাঁচা রাস্তার পাশে উঁচু ভিটের ওপরে তার ছোট্ট ঘর। মাঝখানে একটু খালি জায়গা রেখে ভাঙাচোরা রান্নাঘর। দুপুরের রান্নার আগে সকলেই বেশ অলস সময় কাটাচ্ছিলেন। বাড়ির কাছে যেতেই এগিয়ে এলেন ছিটু খালাসী। তার দ্বিতীয় স্ত্রী মালতি বেগম রোগাক্রান্ত শিশু নাতিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন ঘরের সামনে। ঘরের খুব কাছেই বয়ে গেছে মেঘনা। ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করতেই ছিটু খালাসীর মুখে কষ্ট আড়াল করা হাসি- ‘ভালো আছি’। তারপর একের পর এক গল্প।

 



ছিটু মিয়া খালাসীর কাঁধে সংসারের বোঝা সেই ছোট বেলায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম স্ত্রী নূরজাহান বেগমকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ২ বাচ্চা রেখে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান নূরজাহান। সংসারের হাল ঠিক রাখতে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়। শুধু কি সংসারের বোঝা! নদীর ভাঙন তার জীবনের গতি বদলে দেয় বারবার। একবার ঠিকানা হারায়, আবার নতুন ঠিকানার সন্ধানে নামেন। পুরানো হাইমচরের হায়াত মালের কান্দি ছিল তার প্রথম বাড়ি। ৫ বার জায়গা বদল করে এই গোলদারকান্দি ঠাঁই হয়েছে। তবে এখান থেকেও সরে যেতে হবে। নদী চলে এসেছে নিকটে। তাই এখন থেকেই বাড়ি বদলের প্রস্তুতি চলছে।

গোলদারকান্দির এই বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন আশপাশের বাড়ির আরও কয়েকজন। সিরাজুল ইসলাম বয়াতির স্ত্রী পরিবানু, কৃষক বাদল সরকার, আজাদ হোসেনসহ আরও কয়েকজন জানালেন একই কথা। হাইমচর গিলে খায় মেঘনা; সেইসঙ্গে ঠিকানা হারায় হাইমচরের হাজারো মানুষ। গোলদারকান্দি আর সরকারকান্দির লোকালয়ের পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে নদী এগিয়ে আসার দৃশ্যই চোখে ভাসে। খোলা মাঠ, সয়াবিন ক্ষেত, পাট ক্ষেত, সরু খাল, তার ওপর ভাঙা কাঠের ব্রীজ, ফাঁকা বাড়িঘর, তার পাশে মেঘনার প্রবাহ। বর্ষা এলে এই এলাকার মানুষের আতঙ্ক বেড়ে যায়।

উত্তরে পুরানো সরকারকান্দি ভেঙে আরেক সরকারকান্দি গড়েছে হাইমচরের দক্ষিণে। কাছেই খাল, মাছঘাট, নতুন পাকা ব্রীজ, এরই গা ঘেঁষে সূর্যবাতির নতুন পিলার, আছে কিছু দোকানপাট। বিকালে মানুষের জটলা। কয়েকজন বয়সী মানুষ। এদের একজন ধানু মোল্লা। বয়স ৫৫। বাবামায়ের দেওয়া দাদন মোল্লা নামটি হারিয়ে গিয়ে কবে ‘ধানু মোল্লা’ হয়েছে জানেন না। জানালেন, জীবনে বাড়ি বদল করেছেন ৯ বার। অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। একইভাবে পাশে বসা নানু মাঝিও তার আসল নামটি খুঁজেই পেলেন না। তার নানী নানু ভাই ডাকতে ডাকতে নানু মিয়া নামটিই সবার কাছে পরিচিত হয়েছে। সেই থেকে নানু মাঝি। এখানে কথা বলি আরও কয়েকজন বয়সী মানুষের সঙ্গে। ইয়াজুল হক মোল্লা, রফিকুল ইসলাম, আবুল কাসেম বকাউল, মিয়াজউদ্দিন মোল্লা, নূর ইসলাম বেপারী, ওমর আলী হাওলাদার, গিয়াসউদ্দিন বাঘসহ আরও অনেকে জানালেন হাইমচর এবং এখানকার মানুষের ঠিকানা বদলের কথা। যাদে সাথে কথা বলি, এদের কারও বয়স ৫৫, কারও ৬৫, কার ৭০, কারও ৭৪। এই বয়সে মানুষগুলো কেউ ৮বার, কেউ ৯বার, কেউ ৫বার বাড়ি বদল করেছে।

 



হাইমচরের ‘রাজধানী’ সাহেবগঞ্জ বাজার। কবে কিভাবে এই বাজারের নামকরণ হয়েছে; তা বলতে পারলেন না এলাকার মানুষ। দিনভর নানান কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো বাজারে আসেন সন্ধ্যায়। তাই সারাদিন বাজারটি পড়ে থাকে বিরাণ, ফাঁকা। ক্রেতা না থাকায় অনেক দোকানপাট থাকে বন্ধ। কিন্তু বিকালে-সন্ধ্যায় সকলে ভিড় করেন এই বাজারে। কেউ আসেন কেনাকাটা করতে, কেউ আসেন কিছু বিক্রি করে কিছু কিনে নিয়ে যেতে, আবার কেউ আসেন শুধু সময় কাটাতে কিংবা স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে। আলাপে আলাপে জমে ওঠে চায়ের টেবিল। আড্ডা চলে রাত অবধি। মুদি দোকানের সঙ্গে চায়ের দোকান অন্য কোথাও খুব একটা দেখা যায়নি; যেটা দেখি সাহেবগঞ্জ বাজারে। দুই ধরণের দোকান দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ব্যবসায়ীরা। সাহেবগঞ্জ বাজারের প্রধান গলিতে সাগর আহমেদের টেইলারিং দোকান। নিজেই কাপড় কাটেন। সেলাইয়ের জন্য লোক আছে। দোকানের একপাশে সেলাই মেশিন আছে চারটি। এখানে সাগর আহমেদ ছাড়াও আলাপ হয় কৃষক শাহজালাল বয়াতি, আরেক টেইলর কামাল মোল্লা এবং শিক্ষক আনোয়ারুল আজিম সবুজের সঙ্গে। তাদের কাছ থেকেও শুনি বদলের কিছু গল্প। হাইমচরের হারানো ঠিকানা, এখানকার মানুষের হারানো ঠিকানা। বিদ্যালয়, হাটবাজার, বাড়িঘর, ট্রলার ঘাট আরও অনেক স্থাপনা বদল করতে হয় বারবার। বর্ষার আগে ঠিকানা এপারে থাকলে, বর্ষার পরে ঘর বাঁধতে হয় ওপারে।

আনোয়ারুল আজিম, যিনি সবুজ নামে সবার কাছে পরিচিত। স্থানীয় শিক্ষিত যুবক। শ্রম-ঘামে গড়েছেন একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যিনি এমজেএসকেএসএনএম জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন। যাকে এলাকার মানুষেরা অন্ধকার দ্বীপে আলো ছড়ানোর কারিগর হিসাবে চেনেন; তিনি জানালেন এখানে মানুষ সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকেন। দু’তিন বছরে মানুষগুলো যখন সবকিছু গুছিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, ঠিক তখনই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে। আবার জীবন শুরু হয় শূন্য থেকে। বিগত তিন বছর ধরে ভাঙনের মুখে হাইমচর। সামনে বর্ষাকাল রেখে নদীতীরবর্তী মানুষেরা থাকেন অনিশ্চয়তায়। মালেরকান্দি, মোল্লাকান্দি, গোলদারকান্দি, গাজীকান্দি, অ্যালোটমেন্ট, লালমিয়ার চর পুরোটাই হারিয়ে গেছে। অন্য এলাকায় গিয়ে মোল্লাকান্দি আর মালেরকান্দি গড়েছে। পাড়াবদ্ধভাবে, ৮-১০টি কিংবা তারও বেশি পরিবার ছুটছে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। দ্বীপের নতুন সরকারকান্দি, মিয়ার চর, শহীদ কাইয়ূম মালের কান্দি, আদর্শগ্রাম এখনও ভাঙনের মুখে পড়েনি। হাইমচর নামে চাঁদপুরের একটি উপজেলা আছে। কিন্তু এই উপজেলার ইতিহাস ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এককালে হাইমচর উপজেলার সদর ইউনিয়ন হিসাবে মূল ভূ-খণ্ডেই ছিল হাইমচরের অবস্থান। কিন্তু ‘হাইমচর’ নামের কোন ইউনিয়ন এখন আর মূল ভূ-খণ্ডে নেই। পুরনো হাইমচর হারিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদর স্থাপন করা হয়েছে আলগী ইউনিয়নে। হাইমচরের মানুষেরা এখন উপজেলা সদরের কাজে যান আলগীতে। প্রতি সোমবার চৌকিদারেরা উপজেলা সদরে হাজিরা দিতে যান, ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনতে ছোটেন আলগীতে। এমনকি ডাক্তার দেখানো, ওষুধপত্র কেনা, অফিসের কাজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে ভয়াল মেঘনা পাড়ি দিতে হয় এখানকার মানুষদের।

 



সূর্য ওঠার আগে হাইমচর ঘুরে এখানকার মানুষের সকাল হওয়া দেখি; সকালের কাজকর্ম দেখি। কেউ এরইমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন কাজে, কারও ঘর গোছানোর ব্যস্ততা; কেউ বর্গা নেওয়া গরু নিয়ে ছুঁটছে মাঠে, কেউবা ওপারে যেতে ভোর সাড়ে ৬টায় প্রথম খেয়া ধরার জন্য ছুঁটছেন; মাথায় হরেক বোঝা। রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়। মেঘনায় পণ্যবাহী জাহাজের শব্দে দ্বীপ হাইমচরের মানুষের ঘুম ভাঙে। পুব আকাশে উদিত হয় সূর্য। শুরু হয় নতুন আরেকটি দিনের। বার বার ঠিকানা হারানো মানুষেরা বের হয় নতুন ঠিকানার খোঁজে। সাহেবগঞ্জ বাজারে কিশোর খোরশেদ আলমের নতুন হোটেলের উনুনে লাকড়ির ধোঁয়া ওড়ে। ভিড় বাড়ার আগেই গুছিয়ে নিচ্ছে। বাজারের নিকটে কিল্লার পাশে ভাঙা ঘরের দুটো চালা একত্রিত করা ঝুঁপড়িতে ময়দার রুটি বানানোর আয়োজন জাহান আলী সরকারের স্ত্রী মোরশেদা বেগমের। খানিক দূরে দুই শিশু গরম রুটির অপেক্ষায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়