ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মধুর আমার মায়ের হাসি

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুর আমার মায়ের হাসি

|| কেএমএ হাসনাত ||

‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে,

মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।’

প্রতিটি নিঃশ্বাসে, আকণ্ঠ বিশ্বাসে, কর্মে প্রেরণা, জীবন-যাপনে মনুষ্যত্ববোধ বুকে নিয়ে পথ চলতে যে মুখটি সব সময় সামনে জায়গা করে নেয় সেটি আমার মায়ের মুখ। এ মুখের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোনো মুখের তুলনা হয় না, তুলনা করা যায় না। বিশ্বের সব মায়েদের মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদ জীবন নিশ্চিত হোক।

লেখার শুরুটা হয়তো অন্য কোনোভাবে করা যেতো। কিন্তু শুরুতেই যারা তাদের মায়েদের জীবদ্দশায় চরম অবহেলায় ফেলে রেখে জীবনটা বিষময় করে তুলেছেন, মাকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, শাশুড়ির ভরণ-পোষণ করছেন কিন্তু জন্মদাত্রী মায়ের ন্যূনতম খোঁজ রাখেন না তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে লেখাটা শুরু করছি।

আমার জীবনজুড়ে আমার মায়ের অস্তিত্ব বিরাজ করছে। তিনি আমার কাছ থেকে সামান্য সময়ের জন্যও দূরে যান না। আমার জীবনে যা অর্জন সবটাই তার জন্য। যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন আমরা পিতৃহারা হই। স্কুল শিক্ষক ছিলেন আমাদের পিতা। কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর রাজনীতির টানে দেশ বিভাগের পরও তার নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত অব্যাহত ছিল। আর এ কারণে তার সংসারে প্রতি তেমন টান ছিল না। তবে সংসারের প্রতি যে তিনি উদাসিন ছিলেন তা নয়। পিতা হিসেবে তিনি তার কর্তব্যের প্রতি যত্নবান ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর দুই ভাই আর পাঁচ বোনের পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল আমার মা’কে।

জোতদার পরিবারের একমাত্র সন্তান আমাদের পিতা রাজনীতি করতে গিয়ে প্রায় সর্বস্ব হারান। জীবনের প্রতি যত্নবান ছিলেন না। এ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সহায় সম্বল সব বিক্রি করে এক আত্মীয়ের কাছে সব টাকা তুলে দেন। যাতে তিনি ব্যবসা করে আমাদের দেখভাল করতে পারেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে তার আসল রূপ বের হয়ে আসে। পিতার অসুস্থতা বেড়ে গেলে তার চিকিৎসার জন্য ওই আত্মীয়ের কাছে টাকা চাইলে তিনি বেমালুম অস্বীকার করেন। এ ভাবেই আমাদের পিতা অনেকটা বিনা চিকিৎসায় আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান।

সাত সন্তান নিয়ে আমার মা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন। আমার পিতা যখন মারা যান তখন মা’র আঁচলে মাত্র ১০ আনা পয়সা। ঘরে একমুঠো চালও ছিল না। বড় ভাইয়ের কিছু দিন পরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা। বড় বোন ষষ্ঠ শ্রেণীতে, মেজ বোন চতুর্থ শ্রেণীতে আর আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ালেখা করছি। আমার পরের তিন বোনের মধ্যে একবোন দ্বিতীয় শ্রেণীতে আর একজন প্রথম শ্রেণীতে পড়ছিল। সবার ছোট বোনের বয়স মাত্র আড়াই মাস। এ অবস্থায় পিতা আমাদের ছেড়ে চলে যান। এমন সময় আমার মেজ মামা আর আমার পিতার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। অথচ আমার পিতার অর্থে তার চাচাত ভাইয়েরা ব্যারিস্টার হয়েছেন, ডাক্তার হয়েছেন, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েছেন। কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে দেশের মন্ত্রীও হয়েছেন। দুঃসময়ে তারা কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়াননি।

আমার মা ছোট ছোট শিশুদের পড়িয়ে সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করেন। বড় ভাই খন্দকার আল-মহসীন ছোট বেলা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের এলাকাটি ছিল মুসলিম লীগ অধ্যুষিত। এ অবস্থায় বড় ভাই মির্জাপুরে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একই সঙ্গে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত ৬ দফা আন্দোলনের সমর্থনে তিনি প্রথম মির্জাপুরে মিছিল করেন। এর মাঝে ’৬৯-এর গণ আন্দোলন শুরু হয়। ঠিক তখন আমার মা’র হৃদরোগ ধরা পড়লে বড় ভাইকে সংসারের ভার নিতে হয়। তিনি  মির্জাপুর সার্কেল অফিসে (তৎকালীন সিও অফিস) কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর বড় ভাইয়ের দীর্ঘ সংগ্রাম আর মা’র নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা ভাই-বোনেরা সবাই স্নাতক শ্রেণী উত্তীর্ণ হই।

রাজনীতিবিদ পিতার সব সন্তান আমরা সব সময় রাজনীতি সচেতন ছিলাম। আর তার পেছনে প্রেরণা যোগাতেন আমাদের মা। আমি এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষা দিয়ে আইএসএসবি পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পাই। কিন্তু আমার মা’র নিষেধাজ্ঞায় আর যাওয়া হয়নি। যে কারণে তিনি নিষেধ করেছিলেন সেটা আর এখানে উল্লেখ করছি না। এর মধ্যে উচ্চাভিলাষী আর বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ি। সে সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসারীদের জন্য ছিল কঠিন সময়। রাজনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরার কারণে বহুবার জীবনের উপরে হুমকী এসেছে। আমি সেসব অকপটে একমাত্র মা’কে জানাতাম। তিনি সব সময় আমাকে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘অন্যের ক্ষতি করবে না, আর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না।’

আমার সাংবাদিকতা শুরু ১৯৭৮ সাল থেকে। পড়ালেখার পাশাপাশি লেখার প্রতি ঝোঁক ছিল। আর মা আমাকে এ বিষয়েও উৎসাহিত করতেন। তখন মিজানুর রহমান মিজান সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক খবর’ পরবর্তী সময়ে ‘দৈনিক খবর’-এ যোগদানের মাধ্যমে আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরু। আমার মা পেশা হিসেবে শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতাকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে অনুপ্রাণিত করতেন।  তার যুক্তি ছিল এ দুটোর মাধ্যমে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। বিধির বিধান আমার মায়ের অনুপ্রেরণায় এ দুটো পেশার সঙ্গেই আমি জড়িত হতে সক্ষম হয়েছি।

নানা কারণে আমার দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ে মাস্টার্স শেষ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৩ সালে আমার মাস্টার্স যেদিন শেষ হয় সেদিন ব্যাগ গুটিয়ে মির্জাপুর চলে যাই। বাস থেকে নেমে বাসার সামনের মাঠে দেখি এলাকার ছোটরা ক্রিকেট খেলছে। তাদের চাপাচাপিতে ব্যাগটা রেখে তাদের সঙ্গে খেলতে নেমে যাই। এমন সময় মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক পেছন থেকে আমার শার্টের কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে কলেজের একটি ক্লাশ রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের  ক্লাশ নে!’

উপস্থিত এমন ঘটনায় আমি হতবাক! সেইদিন থেকেই আমার শিক্ষক জীবন শুরু। বাসায় গিয়ে ঘটনা মাকে বললাম। তিনি বললেন, ‘রাজ্জাককে আমি বলেছিলাম। তোকে কলেজে ঢুকিয়ে দিতে।’

এভাবেই শিক্ষকতার পাশাপাশি আমার সাংবাদিকতাও চলছিল। একটানা ১৫ বছর শিক্ষকতা করি। শিক্ষক হিসেবে কতটা যোগ্য ছিলাম সে নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ আছে। তবে শিক্ষক জীবনে ছাত্রছাত্রী আর এলাকাবাসীর প্রচুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছি। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃতও হয়েছি।

মায়ের নির্দেশ আর অনুপ্রেরণায় শিক্ষকতার পাশপাশি সমাজকল্যাণমূলক নানা কাজেও জড়িত হয়ে পড়ি। সালটা ১৯৯২, চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সে বার আমার মা তার ব্যবহৃত এবং নতুন কতগুলো কাপড় ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘না জানি সেখানকার কি অবস্থা। পারলে তুমি গিয়ে দেখে আসো।’ সেদিনই আমি চট্টগ্রাম ছুটে যাই। কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ আর মায়ের দেওয়া কাপড়গুলো নিয়ে। অনেক চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গিয়ে শুনি কুতুবদিয়ার অবস্থা খুবই শোচনীয়। কক্সবাজার গিয়ে পূর্বপরিচিত নৌ-বাহিনীর এক কর্মকর্তার দেখা পাই। তার সহযোগিতায় কুতুবদিয়ায় পৌঁছানোর পর বর্ণনাতীত অবস্থা দেখতে পাই। মানুষ ও জীব-জানোয়ারের লাশ ফুলে ফেঁপে একাকার। পরিবেশ বিপন্ন। এভাবে থাকলে যারা বেঁচে ছিলেন তাদের পক্ষেও বেঁচে থাক সম্ভব ছিল না।

এর মাঝে স্থানীয় এক অধিবাসীর সঙ্গে উত্তর ধুরং নামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি লতাপাতা দিয়ে ঘেরাও করা একটি জায়গা। ভেতরে মানুষের নড়াচড়া বুঝতে পারি। এগিয়ে যেতেই দুর্বোধ্য ভাষায় ওরা কি যেন বলছিল। স্থানীয় সঙ্গীটি বললেন, ওরা ওদিকে যেতে না করছে। কারণ তাদের পরিধানে কোনো বস্ত্র নাই। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে মায়ের দেওয়া কাপড়গুলো দিলাম। তাদের চোখে যে কৃতজ্ঞতার ভাষা দেখেছিলাম তা আজো ভোলার মতো নয়। মা যখন কাপড়গুলো দিয়েছিলেন তখন তাকে বলেছিলাম, ‘এগুলো দিয়ে কী করবো?’ তিনি বলেছিলেন, ‘নিয়ে যা কাজে লাগতেও তো পারে।’ আজ বুঝি আমার মা’র চিন্তার দূরদর্শীতা কতটা প্রখর ছিল।

এরই মধ্যে আমার কলেজ শাখার ছাত্রদলের কিছুসংখ্যক কর্মীর হাতে কলেজের উপাধ্যক্ষ হারুন-উর-রশীদ নিগৃহীত হলে আমি তার তীব্র প্রতিবাদ করলে তারা আমার উপরও ক্ষীপ্ত হয়। ফলে আমার পক্ষে আর সেখানে কাজ করা সম্ভব হয়নি। ২০০১ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান  চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘দৈনিক মানবজমিন’ পত্রিকায় যোগ দেই। এসময় মা আবার রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। টানা পাঁচবছর প্রতিদিন মির্জাপুর থেকে ঢাকায় অফিস করতাম। অফিস কোনোভাবে জানতে পারেনি। এই নিয়ে মায়ের চিন্তার কমতি ছিল না। অফিস শেষে প্রতিদিন বাসায় ফিরতে রাত ১২টা বেজে যেতো। আমার মা এই পাঁচবছর প্রতিদিন আমার জন্য বাসার তিন তলার বারান্দায় বসে থাকতেন। টেবিলে রাতের খাবার দেওয়া থাকতো। আমি না ফেরা পর্যন্ত তিনিও রাতের খাবার খেতেন না।

মা বলতেন, ‘দেখ, সাংবাদিকতা অত্যন্ত পবিত্র একটা পেশা। তোমাদের সংবাদের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বলতে পার সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়। এমন কিছু করবে না যাতে নিরীহ কারো ক্ষতি হয়। সত্য প্রকাশে কোন সময় দ্বিধাবোধ করবে না। আর সারা জীবন সততার সঙ্গে নিজের পেশাটা বাঁচিয়ে রাখবে।’

আজ মা আমার পাশে নেই, তবে তার জীবনাদর্শ আমার পাথেয় হয়ে আছে, থাকবে চিরকাল। বিশ্ব মা দিবসে সকল মায়ের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। আর বিনীত অনুরোধ মা’কে অবহেলা করবেন না। সন্তানের সঙ্গে একমাত্র নিঃস্বার্থ সম্পর্ক হচ্ছে মায়ের সঙ্গে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ১৩ মে ২০১৮/হাসনাত/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়