ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শ্যাননের মা একটা নয়, একশটা

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্যাননের মা একটা নয়, একশটা

ইয়াসিন হাসান : শ্যানন কখনও ওর মাকে দেখেনি। তাই মার বয়সি কাউকে দেখলেই তাকিয়ে থাকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চিন্তা করে, ইশ! আমার মাও বুঝি এমনই হতো। স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি আমাদের আম্মুরা যখন আমাদের এটা-ওটা দিত তখন ও খুব মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকত। একদিন মা আমাকে একটা চুমু দিয়েছিল স্কুলে ঢোকার আগে। শ্যানন ওটা দেখেছিল। দেখে দৌড়ে চলে গিয়েছিল। আমি পিছু নিয়েছিলাম ওর। দেখি হাউমাউ করে ও কাঁদছে।

বলছিল, আমার মা কেন নেই? সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, আমাদের সবার মা একটা। আর তোর মা তো একশটা। কিন্তু ওটা কথার কথা সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তাই সবার মধ্যে নিজের মাকে খুঁজে বেড়ায়।  ওর ভাবনা চিন্তা শুধু ওতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ। কখনো মাকে যে দেখেনি ও। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা হারায় শ্যানন। বাবার কোলে বড় হওয়া ছেলেটা বাবার ভালোবাসা পাওয়ারও সৌভাগ্য বেশিদিন হয়নি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যায় ৪ বছর বয়সে। ছেলেটা বড় হয়েছে বড় ভাইয়ের কাছে। আজ শ্যানন বড় একটি করপোরেট হাউজের বড় কর্মকর্তা। বেতন তো ছয় অঙ্কের! কিন্ত মায়ের অভাব এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।  যেদিন প্রথম চাকরি হলো সেদিন শ্যানন একটা চিঠি লিখেছিল-

‘প্রিয়’ মা,
মা তুমি নিষ্ঠুর কেন! তুমি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে নিজে চলে গেলে অজানা গন্তব্যে। আমাকে কেন রেখে গেলে। আমি তো তোমার সাথে দশটা মাস ছিলাম। এরপরও তোমার সাথে না হয় থাকতাম। আমাকে কেন একা রেখে গেলে?

আমাকে যেদিন তুমি পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলে সেদিন আমার ওজন ছিল আড়াই কেজি। আজ সত্তর কেজি। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হয়েছি। জানো মা এতটুকু হতে আমাকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে। প্রতিটা সময়, প্রতিটা মুহূর্তে আমি তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম। তোমাকে প্রতিটা মুহূর্তে আমার দরকার ছিল। কিন্তু পাইনি। আমি ভাবতাম এই বুঝি তুমি চলে আসবে। কিন্তু ...

মা জানো আজ আমার চাকরি হয়েছে। বহু কষ্টে পড়াশোনা করেছি। ভাইয়া আমাকে সব সময় সাপোর্ট করেছে। ভাবীও দেখভাল করেছে। আজ আমার জন্য খুব আনন্দের দিন। কিন্তু আমার তো ইচ্ছে করে আমার প্রথম কামাই দিয়ে তোমাকে কিছু একটা কিনে দেই। কিছু একটা খাওয়াই। ভাইয়ার কাছে শুনেছি তোমার নাকি ইলিশ মাছ খুব পছন্দের। কিন্তু আমার কি দূর্ভাগ্য দেখ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারছি না।

মা জানো, আমি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি না। বড় হতে হতে দেখেছি খারাপ কিছু করলে বাবা-মাকে খারাপ বলে। তাই আমি খারাপ কিছু করি না। ভালো কাজ করি যেন সবাই আমাকে লক্ষ্মী বলে।

জানো মা, আমি প্রায়ই তোমার কবরে যাই। পাশেই তো বাবার কবর। গিয়ে দোয়া পড়ি, তোমাদের সাথে গল্প করি। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি যেন তোমাদের বেহেশত নসিব করে। বাবাকে কিছুটা সময়ের জন্য পেয়েছি। তাই বাবার স্মৃতি আছে আমার কাছে। কিন্তু তোমার কিছু নেই আমার কাছে। মা তুমি একবার আমার কাছে এসো। তুমি আমার কাছে একবারের জন্য হলেও এসো। এক মুহূর্তের জন্য হলেও এসো। আমি যখন সবাইকে দেখি মাকে নিয়ে কতো মজা করতে তখন আমি ওখানে থাকতে পারি না। আমাকে একবার তোমার বুকে জড়িয়ে ধরো। মা একবার ধরো না…মা একবার ধরো… মা ...মা... ও মা …

শ্যানন লেখাটা শেষ করতে পারেনি। শেষ করেই বা কী হবে? কাকে দেবে, কোন ঠিকানায় দেবে? ১৩ মে ওর মায়ের মৃত্যু দিন। আবার ওর জন্মদিন। কাকতালীয়ভাবে আজ ১৩ মে, বিশ্ব মা দিবস। মা দিবসের এ দিনটা শ্যানন কোনোভাবে ভুলতে পারে না। খুব কষ্ট হয় ওর। কিন্তু দিনটাতে খানিকটা হলেও আনন্দ দিতে শ্যানন ছুটে যায় আরমানিটোলায়। ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। ওর অনেক মা ওখানে। দিনটা তাঁদের সাথে কাটায় ও। শ্যানন সব সময় বলে ওখানে গেলে ওর হাল্কা লাগে। মনে হয় ওর মা-ই বুঝি ওকে আদর করছে। প্রত্যেকের জন্য উপহার কিনে নিয়ে যায় সে। প্রত্যেকের জন্য খাবারের আয়োজন করে। ওকে ওই একটা দিনই দেখে ভালো লাগে। আজ মনে হচ্ছে ওর মা একটা নয়, একশটা।

শ্যানন অর্থ উদার, উপযুক্ত। শ্যানন আসলেই উদার। আসলেই উপযুক্ত ছেলে। ওর মা আজ বেঁচে থাকলে কতটাই না গর্ব করতেন।  পৃথিবীতে ভালো থাকুক সব মায়েরা। পৃথিবীতে সুন্দর হোক সকল মায়ের ভালোবাসায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়