ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

উপকূলের পথে

প্রতিকূলে পাতিলা, বৈরিতায় বসবাস!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৪ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রতিকূলে পাতিলা, বৈরিতায় বসবাস!

রফিকুল ইসলাম মন্টু : আকাশজুড়ে কালো মেঘ। ঝড়ের আশঙ্কা। হঠাৎ বেড়ে গেল বাতাস। ঘরমুখো মানুষের ছোটাছুটি। অবশেষে বৃষ্টি নামলো প্রবল বেগে। সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। ফসলি মাঠ, পুকুর-ডোবা, বাড়িঘরের উঠোন, হাঁটাচলার পথ, সবই পানিতে ডুবল; বাড়লো ভোগান্তি। মাঠে কাজ হবে না; কোন কাজেই বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই। ঘরে খুঁটি বসানো কিংবা চালা ওঠানোর কাজ, পুকুর পাড়ে মাটি ভরাটের কাজ, মাঠে গরু চড়ানোর কাজ- কোনটাই হবে না। ঝড়ের কবলে পড়া একটা অলস বিকেল এলো চর পাতিলায়।

এই চিত্রটাই বলে দেয় দ্বীপ ইউনিয়ন কুকরি মুকরির চর পাতিলার মানুষ কেমন আছেন? একখণ্ড বাঁধহীন জনপদে ঝুঁকিতে বসবাস বারোমাস। ভোলার চরফ্যাসনের কুকরি মুকরির এই ওয়ার্ডটিতে লোকসংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এদের বিপর্যস্ত করে বারবার। ঘরে জমানো সহায়-সম্পদ সব হারায়। এরা আবার মাথা তোলে; চেষ্টা করে ঘুরে দাঁড়ানোর। কিন্তু কতটা পারছে? অবস্থা তো বদলাচ্ছে না মোটেই! কুকরি বাজারের ঘাট থেকে বনের ভেতর দিয়ে উত্তরের নদী ঘুরে পাতিলার পথে। রোদ-মেঘের খেলাটা শুরু সেই সকাল থেকেই। আকাশে মেঘের ঘনঘটা; বৃষ্টি হতে পারে। ইঞ্জিন নৌকার শব্দে কেওড়াবনে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ ম্লান। আঁকাবাঁকা শান্ত নদীর বুক চিরে এগোয় নৌকা। ভাটার টানে কেওড়ার শ্বাসমূলে পলির শুকনো আবরণ স্পষ্ট। স্বল্প পানিতে মাছেদের ছোটাছুটি। জেলেদের কেউ জাল পেতে বসে আছে মাছের অপেক্ষায়। এরই মাঝে পাতিলার উত্তর সীমানায় ধাক্কা খেল ইঞ্জিন নৌকা। পাতিলার উত্তরে ভূমি থেকে বেশ উঁচু মাটির কিল্লাটি ঢেকে আছে সবুজ ঘাসে। বিপদে-আপদে এটাই দ্বীপের মানুষের আশ্রয়ের ভরসাস্থল।

উঁচু মাটির কিল্লার ওপরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করি পাতিলার দৃশ্যপট; শার্টার টিপি। ক্যামেরা ভিউফাইন্ডারে দেখি- দিগন্তজোড়া খোলা মাঠ, সরু চলার পথ, ছড়ানো-ছিটানো ছোট ছোট বাড়ি, নতুন টিনের ঘর, ঘড়ের ঘর, ভাঙা সাঁকো, দু’দিকে ঘেরা ঘন বন, নতুন পুকুর পাড়, আরও অনেক কিছু। দ্বীপের উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে বনের পাশ ঘেঁসে আছে সরু চলার পথ। এটা আসলে রাস্তা; কিন্তু রাস্তা না বলে চলার পথ বলাই ভালো। চর পাতিলার দক্ষিণপ্রান্তে পৌঁছাতে পার হতে হয় বেশ কয়েকটি সাঁকো। কিন্তু বাইরে থেকে আগন্তুকদের পক্ষে এই সাঁকো পারাপার সম্ভব নয়। দুটো গাছ ফেলে রেখে বানানো হয়েছে এ সাঁকো। ধরার কিছু নেই। প্রথম এবং দ্বিতীয় সাঁকোটি একই রকম। তৃতীয় সাঁকোটি পারাপারের জন্য ধরার সুযোগ আছে একটি চিকন রশি। পশ্চিম থেকে পূর্বে মাছঘাটের দিকে যেতে পার হতে হয় আরেকটি কাঠের ব্রিজ। ব্রিজ বলতে যা বোঝায়; তার ধারেকাছেও নয় এটি। বহু পুরনো এ সাঁকোর পাটাতন সরে গেছে; খুঁটি নড়বড়ে। শুকনো মৌসুমে এইসব ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পারাপার না হয়ে পাশ দিয়েও যাওয়া সম্ভব; তবে বর্ষায় এগুলোই ভরসা। ঘটে অনেক দুর্ঘটনা। তবে সাঁকো কিংবা ব্রিজ থেকে পড়ে যাওয়াকে এ এলাকার মানুষ ‘দুর্ঘটনা’ বলে মনে করেন না।

উত্তর থেকে দুর্গম পথ পেরিয়ে চর পাতিলার পূর্ব সীমানার বাজারে। তিন দিকে সারি সারি দোকান। মাঝখানে খোলা জায়গায় খানিক ইট বিছানো রাস্তা। উপকূলের অন্যান্য দ্বীপের মতই পাতিলার এই বাজার। এ অঞ্চলের বাজারগুলো এভাবেই গড়ে ওঠে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই দ্বীপের বাজার জমজমাট হতে থাকে। সূর্যবাতির আলো জ্বলে, সাউন্ডবক্সে গান বাজে, চায়ের দোকানে বাংলা সিনেমা চলে, টিভির পর্দায় দর্শকের অপলক দৃষ্টির মাঝেই সামনে চলে আসে কাপের পর কাপ চা। দ্বীপের দুর্ভোগ-ভোগান্তি, সারাদিনের কষ্ট-ক্লান্তি তখন মানুষজন একেবারেই ভুলে যায়। জেলে, কৃষক, মজুর, রাখাল, বাথান- সবার ভিড় জমে বাজারগুলোতে। গোটা দ্বীপের ভোগান্তির চিত্র ভুলে গিয়ে পাতিলা বাজারের এই দৃশ্যটুকু ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করলে এখানে কোন সংকট দেখা যাবে না। কিন্তু ক্লান্ত দুপুরে পাতিলা বাজারের শফিজল হকসহ আরও কয়েকজন এই ফ্রেমের বাইরের কথাগুলোই বললেন। ‘পানি বাড়লে মাচা পেতে থাকি। ঘর ডুবলে ঘরের চালায় উঠি। জোয়ারের পানি বাড়লে ভোগান্তির শেষ থাকে না। বছর বছর ফসল মার খায়। দ্বীপের মানুষেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন না।’ এক নিঃশ্বাসে  কথাগুলো বললেন শফিজল হক। শফিজল হকের কথায় সায় দেন মুদি দোকানদার রাসেল মিয়া, কৃষক জালাল উদ্দিন, জেলে আইয়ূব হোসেনসহ আরও অনেকে। এদের কথায় বুঝি, ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ সংকেত দেয়া হলে, ঝড়ের ঝাপটা এলে, জোয়ারের পানি বাড়লে বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ে। স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেও তলিয়ে যায় পাতিলার বিস্তীর্ণ মাঠ-ঘাট, বাড়িঘর। এরই প্রমাণ মেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই; শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি।



দুর্যোগকালের ভোগান্তি বোঝাতে মজুর অলিউদ্দিনের ভেসে যাওয়ার গল্পটি বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আইলায় পানি বেড়েছিল অস্বাভাবিক। মানুষগুলো প্রথমে ঘরের ভেতরে মাচা পেতে ছিলেন। পরে আশ্রয় হয় ঘরের চালায়। পানি আরও বেড়ে গেলে চালাও ভাসতে থাকে। সেই চালায় ভেসে যাচ্ছিলেন মজুর অলিউদ্দিন। সঙ্গে তার স্ত্রী ছকিনা বিবি আর ৬ ছেলেমেয়ে। অলিউদ্দিন সবার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিচ্ছিলেন। আর হয়তো ফিরতে পারবেন না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ফিরেছেন অলিউদ্দিন।’ ওই ঝড়ে অনেক কুকরি গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে; অনেকে আবার বনের গাছ ধরে বেঁচেছিলেন, জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাঁধহীন দ্বীপ পাতিলায় দুর্যোগ ঝুঁকিটাই সবচেয়ে বেশি বলে জানালেন বাসিন্দারা। তারা জানান, এখানে রাস্তাঘাট নেই, ব্রিজ-কালভার্ট নেই। বর্ষায় যাতায়াত করতে হয় নৌকায়। শুকনো মৌসুমে ভোগান্তি কিছুটা কমলেও বর্ষায় দুর্ভোগের শেষ থাকে না। এখানকার মানুষের জীবন ও সম্পদের নেই কোনো নিরাপত্তা। আশ্রয়ের জন্য একটি মাটির কিল্লা থাকলেও সেটা দ্বীপের একপ্রান্তে; আবার সেখানে লোকসংখ্যাও অনেক কম। ফলে অন্য এলাকার লোকজন সেখানে যেতে পারে না। বহু পুরানো একটি সাইক্লোন শেলটার রয়েছে দ্বীপের আরেক প্রান্তে। তবে সেটা এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে, আশ্রয়ের কোনো সুযোগ নেই।

মানুষের জটলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেই- এক নাম্বার সমস্যা কী? বেশিরভাগ মানুষের কাছ থেকে জবাব আসে- বেড়িবাঁধ না থাকায় পানি ওঠে। সে কারণে বাঁধ নির্মাণের দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান। ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে পারলে এখানকার মানুষেরা নিরাপদে বসবাস করতে পারে। তবে বাঁধ নির্মাণ করলেই হবে না; নির্মাণ করতে হবে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। মানুষের কথা অনুযায়ী, এখানে দ্বিতীয় সমস্যা হিসাবে আসে রাস্তাঘাট। অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো হলে মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। এরপর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়ার দাবি তাদের। স্বাস্থ্যচিত্র সাম্প্রতিককালে কিছুটা উন্নতি হলেও শিক্ষার সমস্যা সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। দ্বীপের খাসজমি এখনও কার্ডপ্রথাতেই আটকে আছে। ভূমিহীন হিসাবে সরকারের কাছ থেকে কার্ড নিয়ে এক একটি পরিবার বসে গেছে একখণ্ড জমিতে। কার্ডে প্রাপ্ত জমি বেচাকেনায় দলিল হয় না; তবুও বেচাকেনা হয় ‘অন্যভাবে’। অনেকে পজিশন বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়। অনেকে আবার বিক্রি করতে বাধ্য হয়। জমিজমা হাত বদলের সুযোগে এখানেও কিছু মানুষ বড়লোক হচ্ছে; আবার কিছু মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব। কাশেম মেম্বার, কুটি বেপারী, আবু হাওলাদার, ওয়াজেদ ফরাজী, সায়েদ ডাক্তার, কাশেম মাষ্টার, নূরনবী মেম্বারসহ আরও অনেকে অল্প সময়ে বেশ সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিভিন্ন ব্যবসায় তাদের পূঁজি খেটেছে। তা দিয়েই তারা সম্পদ গড়েছেন।     

অন্যদিকে, নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বারবার ফসল মার খাওয়া, মাছধরা ট্রলার ডুবে যাওয়া, মাছের ব্যবসায় মার খাওয়া ইত্যাদি কারণে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছে সিরাজ উদ্দিন, আবদুল মান্নান, দুলাল মিয়া, জসিম উদ্দিন, মনির হোসেন, আমচল হক, মোজাহার উদ্দিন, বশির উদ্দিন, রফিক মাঝি, সিদ্দিক মাঝি, হেজুল মাঝি, হানিফ হাওলাদার, মালেক পাটোয়ারী, বসু পাটোয়ারীসহ আরও অনেকের নাম। নদীকূলের মানুষেরা যেমন নদীকে বেছে নেন জীবিকার মাধ্যম হিসাবে; এখানেও তেমনটাই। বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা মাছধরা। কৃষিকাজও করেন কিছু মানুষ। তবে অধিকাংশেরই মাছধরা ও কৃষি কাজ দুটোতেই জীবিকা চলে। কিন্তু বাজার মন্দা। ব্যবসা বাণিজ্য করে অবস্থা বদল করতে পারা মানুষের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। বারবার মার খেয়ে যারা কোনভাবেই এখানে টিকতে পারছে না; তারা ছুটছে অন্যত্র।



পাতিলার পথে হাঁটি, ছবি তুলি। ক্যামেরা ভিউফাইন্ডারে দেখি একই দৃশ্যপট। ফাঁকা বাড়িঘর। দূরে মহিষপালের বাথানের লাঠির কষাঘাত। বৃষ্টির পর মাঠগুলো যেন এক একটি পুকুরে পরিণত হয়েছে। দেখি, নদী কিনারে ইউসুফ মাঝি, সোহেল মাঝির বাড়িতে চকচকে টিনের ঘর। নতুন টিন লাগানো হয়েছে হয়তো। চোখে পড়ে কিছু রঙিন টিনের ঘর। ঘরের ছাউনি-বেড়া সবখানেই রঙিন টিন। সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো। তবে এ সংখ্যা কম। সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ রঙিন কিংবা সাদা টিন দিয়ে অথবা নতুন খড় দিয়ে ঘর তোলে। কিন্তু এ দিয়ে মানুষের অবস্থা পরিমাপ করা যায় না। নিরাপত্তার জন্য, ঝড়-ঝাপটা থেকে বাঁচতে হয়তো বসতির পেছনে কিছু অর্থ বেশি ব্যয় করেন। অধিক খাটুনি দেওয়ার কারণে দৈনন্দিন খাবারের তালিকায়ও হয়তো ভালো কিছু থাকে; কিন্তু চিকিৎসা, শিক্ষা, বস্ত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য ক্ষেত্রে এখানকার মানুষদের খুব একটা বাজেট থাকে না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়