ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মেঘনায় ইলিশ নেই, ঈদও নেই

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ১৬ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘনায় ইলিশ নেই, ঈদও নেই

জুনাইদ আল হাবিব : ‘৩ লাখ ৮ হাজার টিয়া চালান খাটিয়ে নতুন নাও বানাইছি। নতুন করে গাঙ্গে যামু, বড় বড় ইলিশ ধরমু, কপাল ফিরব, পোলাপাইন নিয়া ঈদ করমু। কিন্তু হলো না। ১১জন জাইল্লা লই গাঙ্গে গেছি। বেকেরে আগেই টিয়া দি আইনতে অইছে। কিন্তু যেইভাবে চালান খাটাইছি, সেভাবে ইলিশ পাই নাই। এখন আমাদের পকেট খালি, কীভাবে ঈদ করমু?’

ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল টানা দুই মাস ইলিশ শিকার বন্ধ থাকার পর গত দেড় মাস পার হলেও নদীতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশের আশা পূরণ না হওয়ায় এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেন লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর জেলে শাহ আলম মাঝি। বয়সটা চল্লিশে গিয়ে ঠেকেছে। জেলা সদরের চর রমনী মোহনে বাড়ি। জেলার কমলনগরের মতিরহাট মেঘনায় ইলিশ ধরেন তিনি। মতিরহাট ইলিশ ঘাটের পাশে মেঘনার কূলে বসেই কথা হচ্ছিলো তার সঙ্গে। তিনি এও বলছিলেন, ‘বড় আশা বুক পেতে গাঙ্গে গিয়েছি। কিন্তু যেমন আশা করেছি, তার ধারে-কাছে যাওয়ার চিন্তাও করতে পারিনি। দুই দিনের খরচ ৯ হাজার টিয়া। ইলিশ পাইছি ১৫ হালি। বেইচ্ছি ১৫ হাজার টিয়া। যদি একদম স্বাভাবিকভাবে গাঙ্গে ইলিশ থাকতো তাহলে নিচে হলেও ৩০ হাজার টিয়া কামাই হইতো। অভিযানের টাইমে (নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়) গাঙ্গে নামি নাই। আঁর জাইল্লার কার্ড আছে। অভিযানে আঁই চাল পাইছি। কিন্তু ৪০ কেজি চাল দেওয়ার কথা থাকলেও এবার চাল পাইছি ২৮ কেজি। এ চাল দিয়ে কী সংসার চলে?’

একই চিত্র চাঁদপুরের মেঘনায়। নদীতে মিলছে না ইলিশের দেখা। দ্বীপ হাইমচর ও চর ভৈরবী মেঘনা তীর ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে, ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। কিন্তু এখানে মেঘনার এপাড়-ওপাড় ঘুরে ইলিশের খোঁজ মেলেনি। ইলিশের আকাল চিত্রের দেখা মেলে হাইমচরের ভৈরবী মাছঘাটে গিয়ে। আড়ৎ ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছেন, অভিযানের সময়েও চুপচাপে ইলিশ শিকার হয়েছে। তাই নদীতে ইলিশ নেই। একজনের দেখাদেখি অন্যরাও ইলিশ শিকারে উৎসাহ পেয়েছে।

মেঘনায় ইলিশসহ অন্যান্য মাছ ধরার সঙ্গে মেঘনাপাড়ের বহু মানুষের জীবন-জীবিকার স্রোত বয়ে চলে। এ সখ্যতায় বিবর্ণ রূপ দেখা দেয় নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে অথবা ইলিশের দেখা না মিললে। মেঘনার জেলে ও মেঘনাপাড়ের মৎস্য ব্যবসায়ী, বরফ কারখানার মালিক-শ্রমিক, স্থানীয় দোকানপাটের ব্যবসায়ীদের জীবিকা কেবল নদীর ওপরই নির্ভর। মো. মিলন। বয়স ৩৫ বছর। ২ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে সংসার। মেঘনাপাড়েই চায়ের দোকান। এতেই জীবন বাঁচে। বড় ছেলে জিহাদকে পড়ান ৩য় শ্রেণীতে। তিনি বলছিলেন, ‘নদীর জেলেদের আয় থাকলে আমাদের আয়। কারণ নদীতে গিয়ে তারা যদি মাছ না পায়, তাহলে দোকানের বেচাকেনাও বন্ধ। আর বেচাকেনা না হলে আমাদের আয়-রোজগারও হবে না। এতে আমরাও ইচ্ছে করলে ঈদে আনন্দ-ফুর্তি করতে পারি না। এজন্য আমরাও বলতে গেলে নদীতে মাছ পাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। তা ছাড়া জেলেদের বাকি দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও সম্ভব না।’

মতিরহাট ইলিশ ঘাটে বসে কথা হচ্ছিল আরেকজন জেলে আনোয়ার আলী সরদারের সঙ্গে। বয়স ৭০ বছর। শরীর অনেকটা ন্যূয়ে পড়েছে। চর কালকিনি ইউনিয়নের জেলে তিনি। খুব আক্ষেপ করে বললেন, ‘ধার-দেনা, ঋণের বোঝা, দোকানে বাকি খাই জীবন কাটাইছি। নদীর কামাইতেই জীবন চলে। আঁই প্রকৃত জাইল্লা হলেও নিবন্ধন কার্ড পাইনি। সরকার বরাদ্দ দিলেও আমরা পাই না, আমরা পামু না।’ তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই অভিযোগ জানালেন একই ইউনিয়নের জেলে বাবুল মাঝি। বয়স ৪৮ এর কোঠায়। তিনি জানান, ‘অভিযানে গাঙ্গেও যাইনি, কামাইও করতে পারিনি। কিন্তু আমারে কেউ একটা কার্ডও দিলো না।’

পূর্ব চর রমণী মোহনের আরেক জেলে নাছির মাঝি। তার বয়স এখন ৪৫ বছর। কার্ড থাকলেও চাল বিতরণ নিয়ে অভিযোগের তীর ছোড়েন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘৪০ কেজি চাইলের জায়গায় আঁরে ৩০ কেজি চাল দিছে। এটা যেন খয়রাত দিছে। সরকার আঙ্গোল্লাই চাইল দিলেও আমরা পাই না। যারা নদী চিনে না, কখনো নদীতে মাছ ধরতে যাই নাই, তারা জাইল্লার কার্ড পায়।’ ২৮ বছর বয়সি কালাম মাঝি নামের আরেক জেলের অভিযোগটাও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলছিলেন, ‘কেউ কেউ অভিযানের সময় বিনা বাঁধায় ইলিশ ধরে। তারা ধরতে পারলে আমরা পারবো না? কার্ড না থাকায় অভিযানে নদীতে পেটের টানে গিয়েছি। এতে নির্যাতিত হয়েছি, জাল পুড়িয়ে ফেলেছে, নৌকা এখনো আটকানো। দেখেন, জেলের কার্ড জেলে না পেয়ে কৃষক ও অন্যান্য পেশার লোক পায়। মাত্র ৪০ শতাংশ জেলে কার্ড পায়, বাকিরা পায় না। যারা কার্ড পায় না, তারা কীভাবে বাঁচে? তা কেউ দেখে না। শুধু আমরা কেন অভিযানে নদীতে যাই, সেজন্য আমাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। নদীতে না গেলে খামু কী করে? অন্য কোনো কাজতো করতে পারি না। বাচ্চা-কাচ্চারা কী না খেয়ে মরবে? ঈদতো দূরের কথা। আগে আমাগোরে ঠিকমতো পেটে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। তারপর যদি আমরা সরকারের কথা না শুনি, তাহলে উপযুক্ত শাস্তি দিলে আমাগো কিছু বলার থাকবে না।’

মতিরহাট ইলিশ ঘাটের সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মেহেদী হাসান লিটন বলেন, ‘১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাস নদীতে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইলিশ ব্যবসা তেমন লাভজনক হয়ে ওঠেনি। তবে আশা করেছিলাম অভিযান শেষ হলে হয়তো ইলিশ পাওয়া যাবে। কিন্তু অভিযান শেষ হয়ে দেড় মাস পার হতে চললেও নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা না পড়ায় সবার মাঝে হতাশা নেমে এসেছে। তাছাড়া অভিযান চলাকালীন জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত কার্ডের সংখ্যা এ অঞ্চলে কম। যার জন্য এখানের বহু জেলেই অভিযানের সময় মানবেতর জীবন পার করে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ঈদ উপলক্ষে জেলে ও নদীতে জীবিকা নির্ভর মানুষের জন্য কোনো বরাদ্দও নেই। নদীতে গিয়ে ইলিশ না পেলে ঈদের আনন্দ  মাটিতে মিশে যায়।’

এ প্রসঙ্গে লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম মুহিবুল্লাহ বলেন, ‘এ সময়ে নদীতে একটু ইলিশ কম থাকে। তবে আগস্টের দিকে প্রচুর ইলিশ জালে পড়তে পারে। এখন নদীতে পোনা আছে। এজন্য জেলেদের কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ হয় নি।’ ঈদকেন্দ্রিক জেলে সম্প্রদায়ের জন্য কোনো বাজেট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযান চলাকালে কিছু বরাদ্দ আসে। তবে সেটা অতটা না, যে সকল জেলে পাবে। আর ঈদ উপলক্ষে জেলেদের জন্য কোনো বাজেট নেই।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুন ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়