ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলের পথে

বিচারের আশায় মালেক প্যাদা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৬, ২৪ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিচারের আশায় মালেক প্যাদা

রফিকুল ইসলাম মন্টু: কথা বলতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন খাদিজা বেগম। শোনাচ্ছিলেন নিজের হাতে সাজানো গোছানো বাড়ি থেকে উচ্ছেদের হৃদয়বিদারক সেই গল্পটা। দিনে দুপুরে একদল সশস্ত্র বাহিনী বাড়ির ৫টি ঘর মাটির সঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সেই পরিবারগুলো এখন এখানে-সেখানে ভাসমান জীবন কাটাচ্ছেন। খাদিজা বেগম এবং তার স্বামী মালেক প্যাদা বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, বিচার পাবেন কিনা জানেন না!

উপকূলে পথ চলতে গিয়ে সামনে আসে বহু ঘটনা। হাজারো সমস্যায় ডুবে থাকা প্রান্তিকের খেটে খাওয়া এই মানুষেরা নিজের সমস্যাগুলো নির্ধারণ করতে জানেন না। আবার সূত্র পেলে তারা অনেক ভালোভাবেই বোঝাতে পারেন সংকটের বিষয়গুলো। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজের চরলক্ষ্মীতে আলাপ হচ্ছিল কৃষকদের সঙ্গে। এক একজন কৃষক যেন এক একজন ‘কৃষিবিজ্ঞানী’। চাষাবাদের সংকট নিয়ে এখানে এসে জানতে পারি নানান তথ্য। কিন্তু এরই ফাঁকে জেলে জাকির প্যাদা দিনে দুপুরে বাড়ি উচ্ছেদের যে খবর শোনালেন; তাতে কৃষকদের দেয়া তথ্য চাপা পড়ে যায়। এভাবেই এক খবরের জন্য মাঠে গিয়ে জানতে পারি আরেক খবর। মানুষের গল্প শুনতে শুনতে ছুটি একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আমার নোটবুক ভারি হয়; ফটোফোল্ডারে ছবির সংখ্যা বাড়ে। জাকির প্যাদার কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য জানার পর আমি ছুটে যাই তার বাবা মালেক প্যাদার কাছে। ভর দুপুরে ছেলে শাহীন প্যাদার মোটরবাইকে করে তিনি আমাকে নিয়ে যান চর রুস্তুমে সেই উচ্ছেদ হওয়া বাড়িতে। বিরান পড়ে আছে সেই ভিটে। যেখানে রান্না হতো, যেখানে বসে মানুষগুলো একসঙ্গে বসে সকাল দুপুর বিকালে খাবার খেত; সেখানে এখন গরু-ছাগল খাবারের সন্ধান করছে। গাছপালায় ভরা সেই বাড়িটি এখন ভরে আছে সবুজ ঘাসে।
 


ভর দুপুরে তপ্ত রোদে ভেজা মাটির ওপর পা রেখে চলেছি আমি, মালেক প্যাদা এবং তার ছেলে শাহীন। চলতে চলতে উচ্ছেদের গল্প। সেদিন দুপুরে যে ঘরে রান্নার আয়োজন চলছিল; মানুষগুলো কাজ শেষে খাবার খাবে; সেই ঘরে দিনে দুপুরে আগুন জ্বালিয়ে উচ্ছেদ করার কথা কে ভেবেছিল? মালেক প্যাদা বলছিলেন, প্রায় দশ বছর আগে চর রুস্তুমের তিন একর জমিতে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি এবং তার এক ভাই বারেক হাওলাদার। জমির কাগজপত্রও আছে তার কাছে। কিন্তু হঠাৎ বছর দেড়ের আগে লাঠিসোটা নিয়ে বহু মানুষ একত্রিত হয়ে এসে তার বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সকাল ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে সে অভিযান। মালেক প্যাদা জানালেন, এই জমি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে মামলা চলছিল। কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার হাতে সব দলিলপত্র আছে। বিভিন্ন সময় ঘটনা জানতে এসে আমার পক্ষে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিনা বিচারেই আমাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হতে হলো। আমি একজন ভূমিহীন মানুষ। ভূমিহীন হিসেবে সরকার আমাকে জমি দিয়েছে। আমি সেই জমিতে ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমি এখন কোথায় যাবো? বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন মালেক প্যাদা।

চর রুস্তুমের উচ্ছেদ হওয়া সেই ভিটে থেকে ফিরে নলুয়া বাজারে মালেক প্যাদার ঘরে আসি। ঘরের সামনে ছোট্ট দোকানে মালেক প্যাদার সংসার চলে। দোকানে পেছনে গাদাগাদি করে থাকেন তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে এবং নাতিরা। এলাকায় সাংবাদিক এসেছে শুনে ছুটে এলেন মালেক প্যাদার স্ত্রী খাদিজা বেগম। বলতে থাকেন সেইদিনের হৃদয়বিদারক ঘটনা। নিজের হাতে লাগানো পেঁপে গাছে পেঁপে ধরেছিল; পেয়ারা গাছে পেয়ারা ধরেছিল। পুকুরে ছিল রুই-কাতল মাছ। খোপ ভরা ছিল হাঁস-মুরগি-কবুতর। যে বাড়িতে মোরগের ডাকে সকলের ঘুম ভাঙতো; সেই বাড়িটি তছনছ হওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না খাদিজা। বিভিষীকাময় সেই কাহিনি বলতে গিয়ে খাদিজা আমার সামনেই জ্ঞান হারান এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে ঘরে নেন। খানিক পরে জ্ঞান ফিরলে খাদিজা আবার এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘স্যার আমরা এখন কোথায় যাবো? সারাজীবন কষ্ট করে বাড়িঘর যা করলাম, সবই শেষ হয়ে গেল। আমরা নায্য বিচার চাই।’  

আশপাশের লোকজনের সঙ্গে আলাপে বোঝা গেল, মালেক প্যাদার বাড়ি উচ্ছেদের এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি এলাকার মানুষের মনে দাগ কেটেছে। উচ্ছেদকারীরা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, সেখানে আশপাশের লোকজনের যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটি বাড়ি পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য তারা দেখেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, এমন ঘটনা জীবনে কখনো দেখিনি। ৫টি পরিবার গ্রামবাসীর চোখের সামনে নিঃস্ব হয়ে গেল। কেউ এর প্রতিবাদ করার সাহসটি পর্যন্ত করলো না। পরিবারগুলো যে কতটা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সমবেত সকলেই ঘটনাটি বিস্তারিত লেখার অনুরোধ জানান।
 


উচ্ছেদ হওয়া এই বাড়িতে থাকা পরিবারগুলো কোথায় আছে খোঁজ নেই। ওই বাড়িতে থাকতেন মালেক প্যাদা, তার দুই ছেলে জাকির প্যাদা ও শাহীন প্যাদা, জামাইসহ দুই মেয়ে হাসিনা ও আঁখিনূর এবং মোশাররফ খাঁ নামে আরেকজন। মালেক প্যাদা এবং তার দুই ছেলে নলুয়া বাজারের দোকানের পেছনে ছোট্ট ঘরে থাকেন। মালের প্যাদার বড় মেয়ে হাছিনা, ছোট মেয়ে আঁখিনূর এবং মোশাররফ প্যাদা পাশের খলিফার চরে বেড়িবাঁধের ওপরে ঘর বানিয়ে কোনমতে দিন যাপন করছেন। নলুয়া বাজারে মালেক প্যাদার বাড়ির পেছনে খালের ওপারে খলিফার চর। ভাটার সময় এ খাল পারাপার কষ্টসাধ্য। মালেক প্যাদার অনুরোধে আমি রাজি হই, বাড়ি উচ্ছেদ হওয়ার পর তার দুই মেয়ে কেমন আছে, দেখতে চাই। মালেক প্যাদা খেয়া পার করে ওপারে নেন। পানি কম থাকায় ওপারে ওঠা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। স্লুইজ গেটের পাশে কেওড়া গাছের খুঁটি ধরে আমি বাঁধে উঠি। বাঁধে উঠে খানিক এগোলে হাছিনা বেগমের বাড়ি। স্বামী এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়িবাঁধের বাইরে তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। উচ্ছেদ হওয়া বাড়ির মোশাররফ খাঁ তার পরিবার নিয়ে একইভাবে বাঁধের বাইরে আছেন।

শেষ বয়সে এসে সব হারানো মালেক প্যাদার জীবনের গল্পটা শুনতে চাই। ৭৫ বছর বয়সেও মানুষটা বেশ শক্ত। জীবনভর অধিক খাটুনি দিয়েছেন; শরীরে তার ছাপ স্পষ্ট। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর চরমোন্তাজে আসেন বাবার সঙ্গে। মা ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে যান। পরে বাবাও মারা যান। সে সময় জীবন ছিল অনেক কঠিন। প্রথমে মহিষ বাথান (মহিষের রাখাল) হিসেবে কাজ করেছেন। বিয়ে করার পর কিছুদিন অন্যের বাড়িতে ছিলেন। মহিষ রাখার পর অন্যের জমি আবাদে যুক্ত হন। এভাবে আস্তে আস্তে চরমোন্তাজে নিজের ভীত শক্ত করার চেষ্টা করেন। শ্রম-ঘামে গড়েছিলেন যে বাড়িটি, সেটিও হারিয়েছেন।

চরমোন্তাজের নলুয়া বাজারে মালেক প্যাদা একটি দোকান করেছিলেন অনেক আগেই। সবাই এখন এসে সেই দোকানের পেছনেই উঠেছেন। মালেক প্যাদা নিজে দোকানে বসেন। বড় ছেলে জাকির প্যাদা মাছ ধরে আর ছোট ছেলে শাহীন প্যাদা যাত্রীবাহী মোটরবাইক চালায়। এখাবেই চলে যাচ্ছে তাদের সংসার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এই এলাকায় রয়েছে বহু খাসজমি। ভূমিহীনদেরকে এই খাসজমি বন্দোবস্ত দেয় সরকার। অন্যদিকে খাসজমির পাশেই আবার রয়েছে রেকর্ডীয় জমি। এই দুই ধরণের জমি নিয়ে মালিকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমা এবং এক পর্যায়ে ঘটে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মালেক প্যাদার ঘটনা শুনতে শুনতে জমি নিয়ে বিরোধের আরও একটি ঘটনা জানতে পারি। আবদুস সোবাহান হাওলাদারের ছেলে আবদুর রহিমের ৬ একন জমি নিয়ে বিরোধ চলছে সফি খলিফার সঙ্গে। ১৫ বছর আগের বিরোধ মিটমাটও হয়েছিল। কিন্তু দুবছর ধরে বিরোধ আবার শুরু। বিপক্ষ সফি খালিফার দাবি, জরিপের মাধ্যমে সে জমি পেয়েছে। আর রহিম হাওলাদারের দাবি, তার জমির কাগজপত্র আছে। উপকূলের পথে-প্রান্তরে এভাবেই ঠকছে মানুষ, ভূগছে মানুষ, ধুঁকছে মানুষ। মালেক প্যাদা, খাদিজা বেগম, জাকির প্যাদা, শাহীন প্যাদা, মোশাররফ খাঁ, হাছিনা বেগম আর আঁখিনূর বেগম দৃষ্টান্ত মাত্র। এমন অসংখ্য ঘটনা আমার নোটবুকে। আমার বলপয়েন্টের ডগায় উঠে আসে তাদের আহাজারি। আমি তাদের ছবি তুলি। কথা বলার সময় কেউ কেউ চোখ মোছেন। কখনো আমার চোখও ভিজে ওঠে। একটা খবর প্রকাশ ছাড়া এদের জন্য আমি কী করতে পারি?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়