ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

দেশভাগ: একটি যন্ত্রণার নাম

শিলু হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ১৪ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেশভাগ: একটি যন্ত্রণার নাম

শিলু হোসেন: শহরে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে রানা। চুয়াডাঙ্গা শহরের অদূরে এক গ্রামে বাড়ি। বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। ছোট ভাই গ্রামের স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। রানার বাবা সিরাজ আলীর বয়স হয়েছে, মায়ের শারীরিক অবস্থাও ভালো না। ছেলে চাকরি করছে, নিজেরাও বৃদ্ধ হয়েছে তাই সিদ্ধান্ত নিলো রানার বিয়ে দেবেন। পাশের গ্রামের নামকরা ঘটক ডেকে ছেলের জন্যে পাত্রী খোঁজা শুরু হলো। গ্রামে চাকরিজীবী ছেলের জন্যে বিয়ের পাত্রী পাওয়া দুঃসাধ্য না হওয়ায় দ্রুতই একটা পাত্রী পাওয়া গেলো। বিয়ের দিনক্ষণ সব ঠিক, কিন্তু হুট করেই বিয়েটা বন্ধ হয়ে গেলো রানার। সমস্যা হলো ছেলেরা রিপুজি। প্রতিবেশীর কথায় রিপুজি পরিবারের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে অমত জানালো মেয়ের বাবা।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু জেলার (ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, মাগুরা) গ্রামের মানুষ ‘রিফিউজি’ শব্দটাকে ‘রিপুজি’ বলে। স্থানীয় হিসেবে প্রভাব দেখানোর জন্যে শব্দটাকে রীতিমত তারা গালি হিসেবেই ব্যবহার করে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মিয়ানমার থেকে যে সব রোহিঙ্গারা এদেশে ছুটে আসছে, তাদের সেই ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়টাকে অল্পদিনেই ‘রোইঙ্গা’ গালি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শহরের শ্রমিকশ্রেণির লোকেরা তাদের সহকর্মীদের দুষ্টুমি করে ‘রোইঙ্গা’ বলে ডাকে। গ্রামেও এরকম দেখতে পাওয়া যায়।

এ রকম রানা কিংবা অন্য মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রেই শুধু না, সামাজিক নানাভাবে অপদস্থের স্বীকার হতে হয় তাদের। কিন্তু এই মানুষগুলো স্থানীয়দের ধর্ম-জাতের হলেও তাদের সাথে আচরণ করা হয় অন্যভাবেই।  তাদের অচ্ছুত মনে করা হয়। অপমান করতে, নিচুভাবে দেখতে রোহিঙ্গা শব্দটা যেমন ‘রোইঙ্গা’ গালিতে রূপ নিলো, এমনভাবেই ‘রিপুজি’ শব্দটা গালিতে পরিণত হলো ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে। শব্দটি প্রান্তিক এলাকার মানুষ ওই সময়টাতেই খুঁজে পায়। দেশভাগের সময় তারা যখন দেখলো-এ দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। আবার ও দেশের মানুষ ‘রিফিউজি’ পরিচয় নিয়ে এদেশে আসছে; তখনই  শব্দটার দেখা পেল তারা। তারা খুব ভালোভাবেই বুঝলো রিপুজি আসলে কারা। কয়েক বছর আগেও দেখেছি, পেটের তাড়নায়, মাথা গোঁজার খোঁজে নিজ গ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে ঘর বাধতে ছুটে যাচ্ছে কিছু সম্বলহীন মানুষ (এ ধরনের মানষগুলো এখন অবশ্য শহরে ধর্না দিচ্ছে, কারণ গ্রামেও আর জায়গায় কুলাচ্ছে না)। তো সেই মানুষগুলো বছরের পর বছর আরেক গ্রামের কোন গেরস্থের বাড়িতে কাজ করছে। তারপর খেয়ে না খেয়ে কিছু টাকা জমিয়ে নিজের বাড়ি করার স্বপ্নপূরণ করছে। এক টুকরো জমিতে ছোট্ট ঘর বেঁধে ভাবলো-এবার হয়তো একটু থিতু হলাম, গ্রামের মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে বসবাসের যোগ্যতা হলো এবার। তবে ভিটে ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে ঘর বাঁধার ব্যাপারটা নানা কারণে ঘটেছে।

বন্যায় বাড়ি, ফসল ডুবে গেছে গরীব চাষীর। আবার প্রচণ্ড খরায় ছোট্ট জমিতে একটু ধানের আবাদও করতে পারে নি। তাই পেটের দায়ে, কাজের সন্ধানে কোনো আবাদি এলাকায় ছুটে গেছে। সেখানে কয়েকমাস কাজ করতে করতে জায়গাটার প্রতি, জায়গাটার মানুষের প্রতি মায়া-ভালোবাসা জন্মেছে। তখন সিদ্ধান্ত নিলো সব ছেড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখানেই থাকি কিংবা এখানকার কোনো দরিদ্র ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে ঘর বাঁধি। ঘর বাঁধলেও স্থানীয়দের দাপটে বছরের পর বছর বাস করেও জায়গাটাকে নিজেদের ভাবতে পারেনি। তাই ৪৭-এর দেশভাগের সময়ে গালি হিসেবে আবির্ভূত ‘রিপুজি’ গালিটা এদের প্রাপ্য হয়ে ওঠে।

সবচেয়ে দুঃখর ব্যাপারটা হচ্ছে, সেই রিপুজিদের এক সময় কিছু টাকা-পয়সা হয়েছে।  সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে স্বচ্ছলভাবে চলছে। সন্তান বড়ো হওয়ায় দরকার পড়লো বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বিয়ের জন্যে লোক এলে পাড়া-প্রতিবেশীরা তাদের ‘রিপুজি’ বলে পরিচয় দিয়েছে ওই রানার মতো করে। আবার রিপুজির বাইরেও তাদের পরিচয়ে আরো একটা বিশেষণ লাগাতে চায় তথাকথিত স্থানীয়রা। অন্য এলাকা থেকে আসায় ওই রিপুজিদের কথা বলার সুর স্থানীয়দের কাছে অপরিচিত মনে হয়। এমনকি তাদের কথা শুনে হাসাহাসিও করে তারা। তাই রিপুজির পাশাপাশি তাদের ‘বাঙাল’ বলে কটাক্ষ করা শুরু হলো। এদেশের মানুষ তো বাঙালি, তাহলে তাদেরকে এভাবে কটাক্ষ করে ‘বাঙাল’ বলার দরকার কেন পড়ে? নাকি ‘আমি বাঙালি’, ‘আমি বাংলাদেশের মানুষ’, ‘আমি এদেশকে ভালবাসি’- এসব বুলি শুধুই পাঠ্যপুস্তক নির্ভর।

মানুষ নিজের অবস্থানে আরেকজনকে দেখতে অস্বস্তিবোধ করে; এটাকে হিংসে বলা যেতে পারে। আবার ‘অপর’ পরিচয় দিয়ে অন্যকে ‘অন্য জাতের’ বানিয়ে নিজেকে ‘আপন’ বা ‘স্থানীয়’ বলে স্বস্তি পায়। ‘স্থানীয়’ শব্দটা কতটা ক্ষমতাশীল তা এই রিপুজি ও রোইঙ্গারা টের পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার জেরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হলো। আবার পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা এখানে চলে আসলো। বাধ্য হয়ে পিতৃভূমি ছেড়ে অন্য স্থানীয়দের দখলে চলে যাওয়া, চলে আসার ঘটনা ঘটে গেল। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তারা যে নিজেদের ‘পর’ ভাবা শুরু করলো তা এখনো চলছেই। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটনের পরিকল্পনায় ঘরে বসে বাচ্চাদের মতো কল্পনার গ্রাম আঁকালো র‌্যাডক্লিফ। পেন্সিলের দাগ টেনে কাল্পনিক গ্রাম আঁকানোর ভঙ্গিতে যে ম্যাপ বানালো, সে ম্যাপের পেন্সিলের তলায় পড়ে কত মানুষের অস্তিত্বের হানি ঘটলো, তার খবর শুধু মাথা গোণা পরিসংখ্যানেই পাওয়া যাবে। তবে যারা মরেনি তাদের কষ্ট সেই প্রাণহারানো মানুষের চেয়েও কঠিন। তবে মদ গিলতে গিলতে ম্যাপ আঁকানোর পর র‌্যাডক্লিফ সাহেবের যখন নেশা কাটলো তখন তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন বেশ। এবং এ তথ্যও পাওয়া যায় যে, দেশে ফিরে জীবনের বাকিটা সময় তিনি অনুতপ্তে কাটিয়েছেন।

’৪৭ সাল থেকে শুধু ক্ষিধেই দেখলে চেখে, কার অন্ন কাদের খাওয়া, বোকা ছেলের কান্না পাওয়া- কবির সুমনের একটা গানের লাইন এটা। গানটিতে দেশভাগে বিতাড়িতদের না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা চোখে ভাসে স্পষ্ট। তবে ক্ষিধে ছাড়াও আরো অনেক কিছু ৭১ বছর ধরে চেখে দেখতে হচ্ছে তাদের। আর বাধ্য হয়ে এখন সেগুলো অভ্যেস হয়ে গেছে। খুব পরিচিত নদীটির স্রোতের শব্দ শুনতে না পাওয়ার যন্ত্রণা, বাড়ির পাশের কলাগাছের পাতার শব্দ শুনতে না পাওয়ার আফসোস, পূজা-ঈদের সময় আত্মীয়ের বাড়ি সপরিবারে বেড়াতে যেতে না পারার কষ্ট, চোখাচোখি হওয়া প্রতিবেশী কিশোরীকে ভালোবাসার কথা বলতে না পেরে হুট করে ভিটে ছাড়া কিশোরের আফসোস, বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ছাড়ার যন্ত্রণা, ৪৭ সাল থেকে বসবাস করেও জায়গাটাকে নিজেদের বলতে না পারার যন্ত্রণাও চেখে দেখতে হয় তাদের। সেই মানুষগুলোর অনেকেই এখন হয়তো বেঁচে নেই, কিন্তু তার সন্তানরা আছে যাদের ভেতর এসব যন্ত্রণা ঠিকই নড়াচড়া করে। এর স্বাদ দেশভাগে মাটি হারানো মানুষগুলো ছাড়া কেউ পাবে না। বাংলাদেশের অন্যগ্রামে স্থানীয়রা যেমন আরকে গ্রামে গেলেই যেমন ‘রিপুজি’ পরিচয় পেয়ে মানুষ হিসেবে অমর্যাদার স্বীকার হয়, দেশভাগে বিতাড়িতদের অবস্থার পার্থক্য করলে এর থেকে শতগুণ বেশি হবে বৈকি। ১৪-১৫ আগস্টে ভারত-পাকিস্তান ঘরে-পথে-ঘাটে-সভায় তাদের পতাকা উড়িয়ে স্বাধীনতা দিবস পালন করবে। কিন্তু মাতৃভূমি হারানো মানুষের যন্ত্রণার পতাকা উড়াবে কে? মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার কোন পতাকা থাকে না, ভাগ হয়ে যাওয়া এই মানুষদের যেমন নেই।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়