ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলে নারী-৬

দুর্যোগে নারীর বিপদ সবচেয়ে বেশি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্যোগে নারীর বিপদ সবচেয়ে বেশি

 রফিকুল ইসলাম মন্টু

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছিলেন জাহানারা বেগম। ছোট সন্তান কোলে, আরেকজন পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া কিশোরী মাকে অনুসরণ করছিল। রাস্তায় হঠাৎ গাছ পড়ে কিশোরীর এক হাত গাছের ফাঁকে আটকে যায়। ওদিকে দ্রুত পানি বাড়ছিল। আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারলে বাঁচার কোনো আশা নেই। নিভে যাবে তিনটি প্রাণ। নিরূপায় মা অবশেষে কোলের শিশু সন্তানকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কিশোরী কন্যাটিকে রেখেই তিনি ছুটলেন আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। চোখের সামনে প্রাণ গেল মেয়েটির। ঘটনাটি ঘটে বাগেরহাটের শরণখোলার তাফালবাড়িয়া গ্রামে। ঝড়ের তাণ্ডব বেড়ে চললেও স্বামীর সন্ধান না পেয়ে জাহানারা নিজেই সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছিলেন সেদিন। পথে পড়েন বিপদে। শুধু পথেই নয়, আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েও তাদের বিপদের শেষ থাকে না। প্রথমত, ঘর ও সন্তানদের সামলে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়; দ্বিতীয়ত, আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের অবস্থানের জন্য নেই সুষ্ঠু পরিবেশ।
 


শরণখোলার তাফালবাড়িয়ার শেফালি বেগম, সাউথখালীর রোকেয়া বেগমসহ আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হলো। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কীকরণ সংকেতগুলো তারা প্রায় মুখস্থ বলে দিতে পারেন। কত নাম্বার সিগন্যালে কী করণীয়, সে সম্পর্কে তারা খুব সচেতন। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সচেতনতামূলক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা এসেছে। কিন্তু সে অনুযায়ী অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। শেফালী বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল পড়লে নারীদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়। শুকনো খাবার সংরক্ষণ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য আসবাবপত্র গুছিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে নারীরাই বেশি কাজ করেন। কিন্তু তাদের নির্বিঘ্নে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতেই অনেক সমস্যা। আবার আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একই কক্ষে অবস্থান করতে হয়। নারীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। এসব কারণে নারীরা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হন না। উপকূলের অধিকাংশ স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে নারী-শিশুদের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা থাকে না। জরুরি সময় যে যেভাবে পারে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠে যায়। একই কক্ষে নারী-পুরুষ ও শিশুরা গাদাগাদি করে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সময়ও নারীর অধিকারের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয় না। তাদের জন্য থাকে না পৃথক টয়লেট। খাবার, পানি ইত্যাদি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে নারীরা পায় সবার পরে। অন্যদিকে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় দুর্যোগকালে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা থাকে না।

সূত্র বলছে, ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও উপকূলের নারীরা প্রতিবছর নানামূখী দুর্যোগ মোকাবেলা করে। এর মধ্যে নদী ভাঙন প্রধান। বছরের বিভিন্ন সময়ে উপকূলের বহু পরিবার বাড়িঘর বদল করতে বাধ্য হয়। ৫-১০ বার বাড়ি বদল করা পরিবারের সংখ্যাও লিপিবদ্ধ করে শেষ করা যাবে না। কিন্তু দুর্যোগের এই সকল ক্ষেত্রে নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। ঘরের মালামাল সংরক্ষণে বেশি কাজ করেন নারী। এর ওপর রান্নাবান্না, সন্তান লালন এগুলো তো নিয়মিত কাজ। জলোচ্ছ্বাসের পানিতে বাড়িঘর ডুবে গেলে নারীর কাঁধেই চাপে অধিকাংশ দায়িত্ব। পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের মিটার বাঁধ এলাকার ইউসুফ হাওলাদারের পরিবারটি দীর্ঘদিন বাঁধের ধারে বসবাস করছে। নদী যতই ভাঙে ঝুপড়ি ঘরটি তত পেছনে যেতে থাকে। এবারের বর্ষার আগে তার ঘর আরও একবার বদল করতে হয়েছে। এ বাড়িতে গিয়ে ইউসুফ হাওলাদারের দেখা মেলেনি একবারও। দেখা হয় তার স্ত্রী খাদিজা বেগমের সঙ্গে। যে ঘরে এই পরিবারটি মাত্র বছরখানেক ছিল, সে ঘরটি এখন আর নেই। শূন্য ভিটায় পড়ে আছে কিছু মালামাল। আর সেগুলোই গোছাচ্ছিলেন খাদিজা। চোখে পড়ে, ভাঙা স্যুটকেস, খালি ড্রাম, কাঠের বাক্স, সৌরবিদ্যুতের ব্যাটারি, জগ, ভাঙা চৌকি, মেয়ের ছেঁড়া স্কুলব্যাগ আরও অনেক কিছু। কয়েকদিন ধরে এগুলো নতুন ঘরে নেওয়ার কাজ করছেন খাদিজা। ঘরের কাজ নারীর, তাই নারীকেই এসব কাজ করতে হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দুর্যোগের এই বিশেষ সময় নারী একটু বেশিই বিপদাপন্ন হয়। প্রতিবছর উপকূলের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঠিকানা বদলায় বহু মানুষ। ভোলার চরফ্যাসনের দ্বীপ ঢালচর থেকে স্বামী ও সন্তানসহ মেয়ে সাথী বেগমের চলে যাওয়া দেখি। ঘর থেকে সব মালামাল আসে নদীর তীরে। সকাল থেকে একই কাজ। তীরে জমানো ঘরের সব মালামাল। নোটবুকে তালিকা নেই। সাথীর স্বামী আকতার আর ভাই ফরহাদ ট্রলারে মালামাল বোঝাই করছে। সাথীর মা খাদিজা মালামাল এনে দিচ্ছে তাদের হাতে। সাথী চলে গেলেন ঢালচর থেকে; থেকে গেলেন তার বাবা-মাসহ অন্য স্বজনেরা। ভর দুপুরে ট্রলারে উঠছিল ঘরের সব মালামাল। মোড়ানো ভাঙা টিন, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল, প্লাস্টিকের ২টি চেয়ার, জগ, হাড়ি-পাতিল, বালিশ সব উঠলো ট্রলারে। বাদ থাকলো না ঘরের আঙিনায় করা বোম্বাই মরিচের চারাগুলোও। এগুলো গোছাতে এবং নদী তীরে আনার সব কাজই করেছেন নারীরা। এর ওপর দুপুরের রান্নার কাজটিও সেরে ফেলতে হয়েছে। দূরে শেষ যাত্রার ট্রলার দ্রুত এগিয়ে চলে কচ্ছপিয়া ঘাটের দিকে। বাবা শহিদুল নিস্তব্ধ বসে রইলেন নদীর পানে তাকিয়ে। সাথীর মা খাদিজা বেগম, দাদি রোশনা বেগম, বোন তাছলিমা বেগম, প্রতিবেশি নাজমা-আমেনার গগণবিদারী কান্নায় সেদিনের মেঘনাপাড়ের আকাশ ছিল ভারি।
 


জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্যোগের কারণে ক্ষতির শিকার মানুষের মধ্যে ৪ শতাংশ অন্তঃসত্তা নারী। গর্ভকালীন জরুরি সেবার অভাবে সন্তান প্রসবকালে অনেক নারী ও কিশোরীর মৃত্যু হয়। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হন। অপর একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, স্বাভাবিক সময়ে বিভিন্ন বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার নারীদের সংকট দুর্যোগ পরিস্থিতিতে আরো বাড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে বাল্যবিয়ের হারও বেড়ে যায়। বিপর্যস্ত এলাকায় নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। বিশেষ করে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারী যৌন হয়রানিসহ নানা হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসাইনের মতে, দুর্যোগের সময় নারী ও শিশুদের আবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয় বলে তাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্থ হয়। ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা অভিমত দিয়েছেন, দুর্যোগে নারী ও শিশুমৃত্যুর হার পুরুষের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি। নারী সচেতন হলে মোট মৃত্যুহার অনেক কমে আসবে। দুর্যোগ প্রতিরোধে নারীর সক্ষমতা থাকলেও নারীকে সব সময় অসহায় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ ধরনের নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন দরকার। শুধু দুর্যোগ নয়, বিভিন্ন সামাজিক ঝুঁকি, দৈনন্দিন আপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়গুলোতেও নারীরা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সে ধরনের সক্ষমতা তৈরির ওপরও জোর দেওয়া হয় আলোচনায়।

লক্ষ্মীপুরের দ্বীপ ইউনিয়ন চর আবদুল্লাহর বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন বলেন, দ্বীপাঞ্চলের নারীরা সব ধরণের ঝুঁকিতে থাকেন। বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢোকা থেকে শুরু করে ঘূর্ণিঝড় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে নারীর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। দুর্যোগ মোকাবেলায় এদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতেও উদ্যোগ নিতে হবে। উপকূলের প্রান্তিক জনপদে নারীদের দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ কোন পদক্ষেপ দেখা যায় না। সন্দ্বীপের দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বলছিলেন, উপকূলের দ্বীপসমূহে দুর্যোগকালে নারীদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেই। অনেক স্থানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। থাকলেও আবার তাতে নারীদের আশ্রয় গ্রহণের মত যথাযথ পরিবেশ নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখা উচিত। একইসঙ্গে গ্রামে গ্রামে নারীদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এভাবে তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। শরণখোলা এলাকায় দুর্যোগ বিষয়ে কর্মরত একাধিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, সামগ্রিকভাবে দুর্যোগ বিষয়ে নানামূখী কাজ হচ্ছে। এতে সফলতাও অর্জিত হয়েছে। তবে বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। কোথাও কোথাও উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা একেবারেই সীমিত। আশ্রয়কেন্দ্র হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সড়কটি ঠিকভাবে হয়নি। আবার আশ্রয়কেন্দ্র হলেও টয়লেট, পানির ব্যবস্থা যথাযথভাবে নেই। নারীদের জন্য এ সুবিধা আরও সীমিত। নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা কীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত উঠতে পারবেন, সে ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব কারণে দুর্যোগে নারীর বিপদাপন্নতা অনেকগুণ বেড়ে যায়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়