ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমার শিক্ষাজীবন ও হুজুর স্যার

তানজিনা আফরিন ইভা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার শিক্ষাজীবন ও হুজুর স্যার

|| তানজিনা ইভা ||

প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে আমাকে চারটি স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। প্রথম স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি খুব বেশি মধুর নয়। আমার ছোট দুই ফুপুর সঙ্গে আমার বয়সের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। ফুপুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম। কিন্তু পর্যাপ্ত বয়স না হওয়ার আগেই স্কুলে যাওয়ার ফল বুঝেছিলাম দু’চার দিন পরেই। এখনকার বাচ্চাদের মতো আগেই বাড়ি থেকে অক্ষর চিনিয়ে দেয়নি আমাকে। অর্থাৎ আমার হাতেখড়িটাও স্কুলে গিয়ে। স্কুলে যাওয়ার পর বাংলা আর ইংরেজির স্যার বললেন, হাতের লেখা তৈরি করে আনতে হবে। আমি তো লিখতেই পারি না, কীভাবে লিখব? দু’তিন দিন হাতের লেখা না নিয়ে যাওয়ার কারণে একদিন ইংরেজি স্যার হাত দুয়েক লম্বা এক কলম লাঠি হিসেবে ব্যবহার করলেন। স্যারের তিন ঘায়ে আমার স্কুলে যাওয়ার সাধ মিটে গেল।  স্কুলে যাওয়া বন্ধ। মা-বাবারও যেন তাড়া ছিল না। আমাদের গ্রামে তখন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চালু করল একটি এনজিও। সেখানে পাশের বাড়ির এক আপা মাস্টার হলেন। তিনিই আমাকে ভর্তির জন্য মা-বাবাকে বললেন। ভর্তি হলাম। কিন্তু স্কুলে যেতে ভয়- যদি মার খেতে হয়। না, পরে আর মার খেতে হয়নি। ওই স্কুলটা ছিল মজার। মনে আছে রং করা বাঁশের কাঠি দিয়ে গণনা শিখিয়েছিলেন আপা। স্কুলের প্রতি যে ভয় তৈরি হয়েছিল তা দূর করে দিলেন তিনি। সেখান  থেকে দু’ ক্লাস পড়ার পর পারিবারিক কারণে চলে যেতে হয়েছিল পাশের জেলা কুষ্টিয়ায়। সেখানকার এক স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া শেষ করলাম। আবার চলে আসতে হলো গ্রামে। পরে সেখান থেকে শেষ হলো আমার প্রাথমিকের গণ্ডি।

এরপর গাড়াগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সেখানেই পাই হুজুর স্যারকে। স্যারের নাম ছিল শামছুল আলম। হুজুর স্যার আমাদের বাংলার ক্লাস নিতেন। মুখে লম্বা দাড়ির কারণে আমরা তাকে হুজুর স্যার বলতাম। হুজুর স্যারের বয়স ছিল স্কুলের সব শিক্ষকের চেয়ে বেশি। তার সঙ্গীরা আরো আগেই অবসর নিয়েছেন। কিন্তু হুজুর স্যার অবসরে যাননি। হুজুর স্যার তার কয়েকজন বন্ধু, সহযোগীদের নিয়ে ১৯৬২ সালে ওই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনো বেতন ছিল না। জমি বিক্রি করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা। এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য, আলোকিত মানুষ তৈরি জন্য।  হুজুর স্যার ক্লাসে ঢুকলে মনে হতো না ক্লাসে আছি। গল্প বলতে বলতে কখন যে পড়াটা শেষ করে দিতেন বোঝা যেত না। একজন শিক্ষক যে শিক্ষার্থীদের বন্ধু হতে পারেন তাকে না দেখলে জানা হতো না। অজানাকে জানার আগ্রহ তৈরি করতে শিখিয়েছিলেন তিনি। তিনিই শিখিয়েছিলেন কী করে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। হায়!  তার জন্য কিছু করার সুযোগ তিনি আমাদের দেননি। যার পান খাওয়ার মতো টাকাও পকেটে থাকত না, তিনিই স্কুলের পিয়নের মেয়ের বিয়ের জন্য টাকার ব্যবস্থা করেছেন। কোনো ছাত্র টাকার অভাবে পড়তে না পারলে তিনিই পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্ত তার জন্য কোনো কিছু করার সুযোগ কাউকে না দিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

১৭ বছরের শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষকই পছন্দের। জীবনের চলার পথটা সহজ করতে অবদান আছে আমার সব শিক্ষকের। কিন্তু যখন প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হয় তখন শামছুল আলম স্যারের মুখ আগে ভেসে ওঠে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যিনি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে গেছেন। তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমার প্রিয় শিক্ষকসহ বিশ্বের সব শিক্ষককে জানাই শ্রদ্ধা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়