ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভুলুয়ার চরে জীবনযাপন যেমন

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৫, ২৩ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভুলুয়ার চরে জীবনযাপন যেমন

জুনাইদ আল হাবিব : ভুলুয়া নদী। এখনকার প্রমত্তা মেঘনার চেয়ে খুবই উত্তাল নদী ছিল এটি। এ ভুলুয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল প্রাচীন ভুলুয়া রাজ্য। এমনকি বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল। যার মধ্যে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা অর্ন্তভূক্ত।

এখন ভুলুয়া আগের মতো নেই। ভুলুয়া একটি বিলুপ্ত নদীতে পরিণত হয়েছে। এখন এটি মেঘনার শাখা নদী। খালগুলোর চেয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতটা জোয়ার-ভাটার ঢেউয়ের খেলা জমে না এ ভুলুয়ার বুকে। বর্ষা হলে পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনে পানিগুলোও সরে না এখান থেকে। এ নিয়ে বাসিন্দা আর কৃষকদের ভোগান্তির শেষ নেই।

এক সময়ের ভয়াল এ ভুলুয়া নদী বহু ভয়ঙ্কর গল্পের সাক্ষী। যা স্মরণ হলে এখনও আঁতকে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন। ভুলুয়া কতটা হিংস্র? সে তথ্যের জন্য চোখ ফেরাতে হবে, ৭০’এর ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’র দিকে।

 



বৃহত্তর রামগতি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি মাষ্টার কামাল হোসেন। এখন বয়সটা ঠিক ৮০ কাছাকাছি। যিনি ওই সময় একজন কলেজ পড়ুয়া ছিলেন নোয়াখালীতে। স্মৃতির পাতার স্মরণীয় গল্প জানতে চাইলে তিনি বলছিলেন, ’১২ নভেম্বর গোটা রাত আমি তখন ভুলুয়ার পাড়ে (আলেকজান্ডার) কাটিয়েছি। চারদিক থেকে মানুষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির মতো গবাধি পশু মরে ভাসতে দেখেছি। আমি আবার আনসারের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমাকে লাশ দাফন করতে দেওয়া হয়েছে। তখন দেখেছি ভুলুয়া তীরে যে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ইতিহাসে বিরল। ভুলুয়ার জোয়ার তোড়ে ২ লাখের মতো মানুষ মারা গেছে।’

এ ঘূর্ণিঝড়ের সময় থেকেই ভুলুয়া নদীর বুকে চর দিতে থাকে। ভাঙনও ছিল বেশ রাক্ষুসে। এ ভাঙন এক সময় থমকে যায় লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরের সীমানায় এসে। এর কয়েক বছর পর ভুলুয়ার চরে লবণ চাষ করা হতো। চিংড়ি উৎপাদনও বেশ লাভজনক ছিল তাই।

ভুলুয়ার চরে গ্রাম থেকে গ্রাম এখন মানুষের বসতি। এসব মানুষের পেশা এখন কৃষি আর মৎস্য শিকার। ভুলুয়ার চর ও বিলুপ্ত নদীতে প্রচুর মাছ পায় এখানকার মানুষ। যা দিয়েই এসব মানুষের জীবনযাপন প্রবাহিত।

 



লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কমলনগর উপজেলার শেষ সীমানা করুণানগর বাজার। এ বড় বাজার থেকে পূর্ব দিকে পায়ে হেঁটে ছোট চক বাজার। সেখান থেকেও পূর্বে দিকে আবার পাঁচ মিনিটের পথ ধরে হাঁটি। একটু সামনে গেলে চোখ পড়ল একটি বেড়িবাঁধ সড়ক। অবশ্য এটি ভুলুয়াতীর রক্ষা বাঁধও বলেন কেউ কেউ। সেখান থেকে উত্তর দিকে ভুলুয়া তীর ঘেঁষে চলছি। একটি নয়নাভিরাম দৃশ্যের কাঠের সাঁকো আর দীঘির প্রকৃতির দিকে মনটা ছুঁয়েছে। কাঠের সেতু দিয়ে পা রাখি ওপারে। এরপর ভুলুয়ার চরেই হাঁটতে থাকি বেশ কয়েক মিনিট। সামনে চোখ যায়, শিশু-কিশোরদের দল ফুটবল খেলছে। কেউ গরু চরাচ্ছেন, কেউ মহিষ। কেউবা আবার প্রকৃতির মায়ায় জড়িয়ে থাকা সবুজ ঘাঁস সংগ্রহ করছেন গবাধি পশু পালনের জন্য। সবুজে মোড়ানো বিশাল কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে চারদিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা মিলে সবুজ আর সবুজ। এ সবুজটা অবশ্য আমন ক্ষেতের। এখানে এখন মানুষজন ধান, সয়াবিন, মরিচ, বাদামের মতো অর্থকরী ফসল উৎপাদন করে স্বাবলম্বী।

পড়ন্ত বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে একটা মেঠো পথের দেখা মেলে পরক্ষণে। এ পথ ধরে একটু হাঁটলেই দেখা চরে বসাবসকারী মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। বয়সটা ২৮ হবে। হাতে খালি কলসি। কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন? ‘কলের পানির লাইগা যাচ্ছি। চরের ওইপারে।’ পানির জন্য ওপারে যাওয়া লাগে? ‘জ্বে। এছাড়া কোনো উপায় নাই।’ কীভাবে যাবেন? ওখানেতো একটা বড় বাঁশের সাঁকো দেখছি। ‘হাক্কাটার উপর দিয়াই যামু।’

বিশুদ্ধ পানির খোঁজে ওপারেই যেতে হয় চরের বাসিন্দাদের। গভীর কিংবা অগভীর কোনো নলকূপও চোখে পড়েনি এখানে। যোগাযোগ ব্যবস্থার নেই কোনো উন্নতি। ভুলুয়ার নদীর ওপর বেশ কয়েকটি বাঁশ নির্মিত সাঁকো দেখা গেল। যেগুলোর দৈর্ঘ্য দু’ থেকে আড়াই’শ ফুট।

 



তাঁর সঙ্গে গল্প শেষে পা পড়ল আরেক বাড়ির দিকে। বাড়ির নাম হোসেন আহম্মদের বাড়ি। এ বাড়িতেই ছোট্ট সুমাইয়া গরুর ঘরে ঘাস নিচ্ছে। আবার সে ঘাস দানাদার খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে গরুকে দিচ্ছে। ঘরের সামনে গেলে এগিয়ে আসেন হোসেন আহম্মদের স্ত্রী বিবি ফাতেমা। বয়সটা ৫৫ ছুঁয়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘আঁর বাপের বাড়ি ছিল নোয়াখালী সদরের কাজির তালুকে। এখানে বিয়ে হয় আমার। এরপর থেকে অনেক বছর ভুলুয়া নদীর পাড়েই ছিলাম। যখন দেখি এ চরে মানুষ বাড়ি-ঘর করতেছে, তখন আমরা এখানে আসি।’

তাঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে হাজির হলেন স্বামী হোসেন আহম্মদ। বয়সটা ৬৫’র উপরে। তিনি বলেন, ‘৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ৫ বছর আগ থেকে আমি ভুলুয়া দেখেছি। সে সময় ভুলুয়া তীরে গরু চরিয়েছি। ভুলুয়া খুব ভয়াল ছিল। গরু-ছাগল ও মিলাদ মানত করে আমরা বৈঠা ও পালতোলা নৌকা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে যেতাম। এখান থেকে বিশেষ করে উদয় সাধুর হাট, চৌমুহনী, মাইজদি। চর যখন কিছুটা জেগে ওঠেছে তখন এখানে খামার বাড়ি ছিল। এখানে অনেক কিছু চাষ করা হতো। গরু-ছাগল রাখার জন্য এ খামার বাড়িগুলো করা হয়েছিল। ৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের সময় কত মানুষ মারা গেছে এর কোনো হিসাব নেই। খামার বাড়িগুলোতে থাকা অনেকেই মারা গেছেন।’

বর্তমানে কী কী সংকট এখানে? জিজ্ঞেস করলে হোসেন আহম্মেদ বলছিলেন, ‘আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে এখানে বাড়ি করেছি। এখানে বিশুদ্ধ খাবারের পানিগুলো ঠিকমত নাই। কাঁচা রাস্তা দিয়ে বর্ষাকালো লোদ-হেক থাকে। সাঁকো দিয়ে নদী পার হতে হয়। অতিবৃষ্টি হলে আমাদের বাড়ি-ঘর ডুবে যায়। খুব কষ্ট হয় তখন। চরে কোনো স্কুলও নাই যে হোলাইন-সাবাইন পড়বে।’

 



ভুলুয়া তীরের দর্জি দোকানদার মো. ইলিয়াছ। বয়স ৩২। তিনি বলেন, ‘আমার বুঝ-জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখি, এখানে মানুষ গরু-মহিষ পালন করে। পানি দিয়ে নৌকায় পারাপর হয়। চর থেকে বন-জঙ্গল কেটে জ্বালানির জন্য আনা হতো। তখন কোনো ফসল হতো না। এটা ১৯৯৭ সালের কথা। ২০০০ সাল থেকে উঁচু স্থানে ফসল চাষ হতো। এখন বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। যার কারণে কৃষকদের ফসলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। এটা অবশ্য মেঘনা নদীর সঙ্গে সংযোগ আছে। রামগতির হাটের কাছ দিয়ে।’

ভুলুয়া তীরের সমাজকর্মী ও হাজিরহাট উপকূল কলেজের স্নাতক শ্রেণী পড়ুয়া মো. ইয়াছিন বলেন, ‘এক সময় এখানে লবণ চাষ হতো। এর পাশাপাশি চিংড়ি চাষও হতো। লবণাক্ততা কেটে যাওয়ার পর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মিলতো এখানে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষাবাদ শুরু হয় এখানে। ফসল উৎপাদন ও মৎস্য আহরণ করেই মূলত এখানের মানুষ টিকে আছে।’

লক্ষ্মীপুরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মাইন উদ্দিন পাঠান মনে করেন, ‘এ ভুলুয়া আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতাগুলো কিন্তু নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। ঠিক নোয়াখালী অঞ্চলটা মূলত ভুলুয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। ভুলুয়াকে কেন্দ্র করে আরো অনেক ইতিহাস জড়িত। এখনকার প্রজন্মের কাছে ভুলুয়া নদীর গল্পটা তেমন জানা নেই। এর জন্য উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ভুলুয়ার চরে এখন যে সম্ভাবনার জনপদ গড়ে ওঠেছে, এখানে দিন দিন মানুষের বসাবস বাড়বে। এখন কোনো জমি খালি নেই যেখানে ফসল উৎপাদন হয় না। এখানে চাষ করা মাছ জেলার হাট-বাজারে আসে। ভুলুয়ার চরে চাষ করা ধান, সয়াবিন, বাদামের মতো কৃষিপণ্য জেলার সম্ভাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ অক্টোবর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়