ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পুলকের বনসাই আঙিনা

জেনিস আক্তার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ৩ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুলকের বনসাই আঙিনা

বনসাই প্রেমিক পুলক সাংমা লেখিকাকে বনসাই দেখিয়ে দিচ্ছেন

জেনিস আক্তার: প্রাচীন চীনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে জাপানী ‘বনসাই’ শব্দের উৎপত্তি। বনসাই করতে ব্যবহৃত ট্রের মতো পাত্রটিকে সাধারণভাবে ‘বন’ বলা হয়। ‘বন’ হলো পাত্র, আর ‘সাই’ হলো গাছ। পাশ্চাত্যে পাত্রে ক্ষর্বাকৃতির গাছ বলতে ‘বনসাই’ বোঝায়। প্রথম দিকে জাপানীরা পাত্রে জন্মানো বামনকৃত গাছ গৃহসজ্জায়  ব্যবহার করত। এক সময় ধনীদের অবসর কাটানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে এ ধরনের গাছ, বিশেষ করে আজালিয়া এবং ম্যাপলের মতো গাছের পরিচর্যা করা বা বাগান করা। বামনকৃত গাছ পাত্রে পালন করাও জনপ্রিয় ছিল। মোটামুটি ১৮০০ সালের দিকে জাপানীরা তুলনামূলকভাবে কম গভীর পাত্রে ক্ষুদ্র গাছ পরিচর্যা করার সাথে সাথে চৈনিক ‘পেনজাই’ শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তন করে ‘বনসাই’ করে ফেলে। এখনও টোকিওর রাজপ্রাসাদে থাকা পুরনো জীবিত একটি বনসাইকে জাপানের জাতীয় সম্পদ বিবেচনা করা হয়।

বাংলায় বনসাইয়ের সমার্থক শব্দ নেই। বনসাই পৃথিবীতে পরিচিত এবং দারুণভাবে জনপ্রিয়। তবে বনসাইকে  ‘রূপসী বৃক্ষ’ বললেই ভালো শোনায়। যে কোনো গাছক থালা জাতীয় টবে লাগালেই তাকে বনসাই বলা যাবে না। বনসাইয়ের মূল হলো প্রকৃতির বিশাল গাছকে অতি ক্ষুদ্রাকারে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা। শুধু ক্ষুদ্রাকারে উপস্থাপন করলেই হবে না, তার ভেতর বয়স্ক বৃক্ষের ছাপ ফুটিয়ে তুলতে হবে। কাজটি করতে হয় অত্যন্ত দক্ষতা ও ধৈর্য্যের সঙ্গে গাছের ব্যাকরণ জেনে। তবেই হয়ে উঠবে প্রকৃতির এক শ্রেষ্ঠ কবিতা, মুগ্ধতা আর বিস্ময় জাগানো জীবন্ত শিল্প। বনসাইকে এ কারণে চির অসমাপ্ত জীবন্ত শিল্প বলা হয়।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা। লবণাক্ত পানির বিস্তৃতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, কারণ কার্বন নির্গমন আমরা বাড়িয়েই চলেছি । নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করছি আর অবিবেচকের মতো প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন করে চলেছি সেখানে প্রকৃতিপ্রেমীক বনসাই শিল্পী পরম যত্নে গাছ লালন করে চলেছেন। গাছের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক। বনসাই শিল্প চর্চাকে অনেকেই মনে করেন-গাছের যেহেতু জীবন আছে, তাই গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে, ডালপালা কেটে গাছের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে, যা অমানবিক। যুক্তির পেছনে যুক্তি থাকে। আমরা যেমন পেটের ক্ষুধা মেটাতে জীব হত্যা করি, সবজি খাই, তেমনি মনের ক্ষুধা দূর করে প্রকৃতির এই সবুজ শিল্প- এভাবেও ভাবা যায়। মূল বিষয়টি হলো, আমরা যদি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি তবে শিল্প আর শিল্প হয়ে উঠবে না, বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রাচীন গাছ। বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষের অবহেলায় পরে থাকা চারা থেকে পরিচর্যা করে বৃক্ষে রূপান্তরিত করছে  বনসাই শিল্পীরা। বনসাই শিল্পী কর্মের মাধ্যমে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য কিছুটা হলেও রক্ষা করে ও দুর্লভ বৃক্ষ সংগ্রহ করে চলেছেন পরম যত্নে। বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহর হিসেবে ঢাকা ২য় স্থানে আছে। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় ঠেকাতে বৃক্ষগুলোকে যদি বনসাই করে বারান্দায়, ঘরে কিংবা ছাদে রাখা যায় তাহলেও আমাদের কিছুটা সবুজের ঘাটতি পূর্ণ হবে। পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে যে, গাছ প্রকৃতির প্রধান অঙ্গ। এই প্রকৃতি আমাদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
 

চায়না বট এর বনসাই


প্রকৃতিকে ভালোবেসে হেমন্তের এমন দিনে গিয়েছি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার লালমাটির টিলা, নিচু বাইদ, সারি সারি কাঁঠাল, আনারস আর লিচু বাগানে গড়া জনপদ ইদিলপুর গ্রামে। এখানেই বাস করেন এক বনসাইপ্রেমী। ভদ্রলোকের পরিবার ঢাকা থাকেন। একমাত্র তিনি বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করতে গ্রামে স্থিতু হয়েছেন ২০০৫ সাল থেকে। কাকরাইদ- গারোবাজার সড়কে দুই কি.মি. এগুলেই ইদিলপুর বাজার। বাজারে নেমে লাল মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই গারোপাড়া। ইদিলপুর হাইস্কুল, খ্রীস্টচার্চ, অরফানেজ ও মিশনারী স্কুল পাড়ি দিয়ে ডানে দেড়শ গজ সামনে পেরুলে হাতের ডানে গাছগাছালিতে ছাওয়া নির্জন বাড়ি। মাটির দেয়ালে ঘেরা দুটি ঘর, শহরের সব রকম সুবিধা নিয়ে ভেতরবাড়ি পাকা। পরিচ্ছন্ন বাড়ির সামনে পিছনে আনারস বাগান। ফল-ফুলে সাজানো চকচকে আঙ্গিনা। বাড়ির মালিক পুলক সাংমা। তিনিই সেই বনসাইপ্রেমী। পুলক পাশের বাড়ির ভেঙ্কট রিছিলের কাছে প্রথম বট ও পাকুড়ের বনসাই দেখেন। এখান থেকেই তার অনুপ্রেরণা।

পুলকের আঙ্গিনাজুড়ে প্রায় ৪০০ বনসাই। পাকুড়, বট, চায়না বট, হিজল, গন্ধরাজ, জবা, ডুমুর, তেঁতুল, শেওড়া, ছাতিম, অশ্বথ, জলডংগা, জারুল, বাগান বিলাসসহ আছে নানা প্রজাতির গাছ। প্রতিটা গাছের ডাল পাতা অবয়ব তার মুখস্থ। এতোটাই ভালবাসা ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি সবকিছু। শখের শিল্প ( Art) কে শিল্পে  (Industry) রূপান্তরিত করতে সচেষ্ট তিনি। কিছু গাছ নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের খামখেয়ালে বেড়ে উঠছে ওভারল্যাপে মানবমানবীর জড়িয়ে থাকা দৃশ্যের মতো অবয়ব নিয়ে। প্রতিটি গাছের বয়স কত হবে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘সুন্দরী রমণীর যেমন বয়স জিজ্ঞেস করতে হয় না, তেমনি বনসাই রুপসী গাছের বয়স জিজ্ঞেস করতে হয় না। দর্শক গাছ দেখে অনুমান করে নেবেন বয়স। এখানেই শিল্পীর সার্থকতা। গাছের মাঝে যদি বয়সের ছাপ না ফেলা যায় তাহলে তো শিল্প হবে না।’

মধুপুরের আশপাশে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনাদরে পরে থাকা, পুরাতন দালানে জড়িয়ে থাকা, পরগাছা হিসেবে গাছে জড়িয়ে থাকা চারা খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করেন তিনি। অনেক সময় পারিশ্রমিকের বিনিময়েও সংগ্রহ করেছেন চারা; দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে। কিছু গাছের বয়স ২৫ ছাড়িয়ে যাবে। আবার দুই ফুট উচ্চতার কিছু গাছ দেখে মনে হয় ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
 

অশ্বথ এর বনসাই  


কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তিনি দীর্ঘ ১৩ বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকার বনসাই বিক্রি করেছেন। কীভাবে পরিচর্যা করছেন? জানতে চাইলে বললেন, বছরে দুইবার জৈব সার ও কেঁচো কম্পোস্ট সার দেই। বছরে একবার মাটি পরিবর্তন করে দুই দিন পরপর হালকা পানি দেই। কিন্তু এটুকু যথেষ্ট নয়। স্বীকার করলেন সেকথা। তারপর নিজেই জানালেন চারা রোদে রাখার মূলমন্ত্র এবং প্রয়োজনে গাছের পাতায় রোগের আক্রমণ বুঝে বিষ প্রয়োগের কথা। যেমন নিয়মিত কালো মাটি, বালু বা ইটের চূর্ণ, সরিষা বা নীলের খোসা ইত্যাদি দিতে হবে। অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা এবং রোদ থেকে দূরে রাখতে হবে। ধুলো-ময়লামুক্ত রাখতে পানি দিয়ে পাতা ও ডাল মুছে দিতে হবে। টবের মাটিতে পোকামাকড় কিংবা ছত্রাক হলে সঠিক মাত্রায় কীটনাশক দিতে হবে। এমন স্থানে রাখতে হবে, যেখানে আলো-বাতাস চলাচল করে কিন্তু লোকজনের যাওয়া-আসা কম।

নির্ধারিত আকৃতি ঠিক রাখতে নির্ধারিত ডালপালা বাদে ছাঁটাই করতে হবে। প্রতি একবছর অন্তর টবের মাটি পরিবর্তন করতে হবে। গাছের ছাঁটাইসহ অন্যান্য কাজে নির্ধারিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। আরো জানালেন সতর্কতার জন্য টবে দো-আঁশ মাটির সঙ্গে জৈব সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। টবের পানি নিষ্কাশনের জন্য ছিদ্রের উপর ইটের কুচির পরিবর্তে এক টুকরা তারের জালি রেখে কাঁকড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

বনসাই বলতে বোঝায় বৃক্ষ জাতীয় গাছ (ফলজ ও বনজ) তার আকৃতি ঠিক রেখে সেগুলোর নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন প্রকার টবে ধারণ করা৷ বনসাইয়ের স্টাইল নানা ধরনের। এর মাঝে মূলত পাঁচটি স্টাইল রয়েছে। যেমন এক. ফরমাল আপ রাইট : এই রীতির গাছগুলো চারদিকে সমানভাবে ডালপালা ছড়িয়ে উপরে ওঠে৷ দুই. ইনফরমাল আপ রাইট : এ রীতির গাছও উপরে ওঠে তবে ডালপালা সাধারণের মতো অত বিন্যস্ত নয়, একটু এলোমেলো৷ তিন. কাসকেড : কাসকেড রীতির গাছগুলো টবের সীমানা ছাড়িয়ে ঝরনার মতো নিচের দিকে গড়িয়ে নামে৷ সেমিকাসডেক বা অর্ধকাসকেড রীতির গাছ টবের প্রান্তসীমায় এসে আটকে যায়৷ একমাত্র কাসকেড ও সেমিকাসকেড বনসাইতে উঁচু পট/টব ব্যবহার করা হয়৷ চার. স্পান্টিং : যে রীতির বনসাইয়ে গাছটি একদিকে হেলে থাকে তাকে স্পান্টিং বলে৷ পাঁচ. রুট ওভার রক।
 

ডুমুরের বনসাই


প্রকৃতির সব গাছ সুন্দর হয় না, তেমনি সব গাছ দিয়ে বনসাই করা যায় না, যেসব গাছ ধীরে বাড়ে সেসব গাছ দিয়েই মূলত বনসাই করা সুবিধা। ছোট্ট একটি ক্যানভাস কিন্তু বিশাল তার ব্যপ্তি, বিশাল তার পরিধি। পুলক আক্ষেপ করে বলেন, অনেক গাছ বিদেশ থেকে সরাসরি আনা হচ্ছে। নিয়ম মেনে বনসাই করা হচ্ছে না। ব্যাঙের ছাতার মত বনসাই সোসাইটি তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র কয়েকটা ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণ ক্লাসের মাধ্যমে। স্বল্প জ্ঞানে বনসাই তৈরি করার ফলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। মানসম্মতভাবে বনসাইকে শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বের কাছে তুলে ধরাটাই এখন পুলকের স্বপ্ন। 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়