ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শিশুরাই হচ্ছে শিশুর বাবা-মা

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২৭ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিশুরাই হচ্ছে শিশুর বাবা-মা

জুনাইদ আল হাবিব : শাহজাহান ও জেসমিন। ভাই-বোন। দুই ভাইয়ের মধ্যে শাহজাহান বড় আর দুই বোনের মধ্যে জেসমিন। শাহজাহানের বয়স চৌদ্দ, জেসমিনের বারো। ওদের বাবার নাম রফিক, মা রহিমা। দরিদ্র বাবা-মায়ের এখন একটাই চিন্তা কীভাবে জেসমিনকে বিয়ে দেয়া যায়? যখন ওর বয়স এগারো, তখন থেকেই বর খোঁজা শুরু করেন তারা। একটা সুযোগ এলো বছর খানেক পর। প্রতিবেশী সিরাজের ছেলে মামুন বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। মামুনের বয়স একুশ ছাড়িয়েছে। জেসমিনের পরিবার রাজি হয়। বলতে গেলে গোপনেই বিয়ে হয়ে যায় তাদের। এখন সংসার জীবনে জেসমিন কেমন আছে?

এ নিয়ে একটা উপন্যাস অথবা চলচ্চিত্র হতে পারে। জেসমিন হয়তো ক’মাস পরেই মা হবেন। তখন খবরের শিরোনাম হতে পারে-শিশুই শিশুর মা! অবশ্য দোষটা জেসমিনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। জেসমিন গ্রামের কওমি মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল। ওর পড়াশোনা বেশিদিন টেকেনি। দারিদ্র্যের সংসার। অভাব-অনটন লেগেই আছে। এমন পরিস্থিতিতে জেসমিনদেরে আপত্তি কখনও টেকে না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মুরুব্বিরা জানত- আঠারো বছরের নিচে বিয়ে দেয়া যায় না। তখন তারা জেসমিনের বয়স কাগজে-কলমে আঠারো দেখিয়েছে। অবৈধ সুযোগটা করে দিয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের কর্তাব্যক্তিরা।  একই কায়দায় শাহজাহানেরও বিয়ে হয়েছে। মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিতে গেলে ‘বাল্যবিয়ে’ বলা হলেও ছেলেদের বেলায় বাল্যবিয়ে বলছে না কেউ। এর প্রমাণ শাহজাহানের বিয়ে। শাহজাহানের বয়সও বাড়িয়ে দেয়ায় সে ভোট দেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে। শাহজাহানের ঘরে যে বধূ হয়ে এসেছে তার নাম নুরভানু। সে বারো বছর বয়সী এক শিশু। নুরভানুর বাবার বাড়ি বেশি দূরে নয়। তাদেরও টানাটানির সংসার। বাবা শাহ আলমের মাথায়ও একই রকমভাবে মেয়ের বিয়ে দেয়ার চিন্তা ছিল। দিতে পেরে মাথা থেকে মস্ত বড় এক বোঝা যেন নেমে গেছে।

উপকূলের মেঘনার কূল সীমান্ত জেলা লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের দক্ষিণ চর মার্টিন গ্রাম। গ্রামের এ ভয়ঙ্কর চিত্রটা বলে দেয়, উপকূলের শিশুরা কতটা অরক্ষিত। একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা মামুন। মামুনের সঠিক বয়সে বিয়ে হলেও তার ছোট বোন রুজিনার বিয়ে হয় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে। বিয়ে হয় বহু দূরের এক যুবকের সঙ্গে। রুজিনা এখন মা। এখনকার বাস্তবতা, শিশুই হচ্ছে শিশুর মা! এটা স্বজনরা ভাগ্য হিসেবে দেখে। যেন অহংকারও। রুজিনার বাবা নিজেকে পরিচয় দিতে পারে নানা হিসেবে। গল্পগুলো একটি মহল্লার। আধা কিলোমিটারের মধ্যে। একই মহল্লার শাবানা আক্তার। বাবার নাম শাহজাহান। শাবানা পড়ছে মাদ্রাসায়। ওর আগেই কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায় বড় তিন বোনের। প্রবাস থেকে এসে ভাই সবুজ বিয়ে করেছে। এরপর শাবানাকে বিয়ে দিতে সংসারের লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ক’দিন আগেই কাজী সাহেবের মাধ্যমে গোপনে শাবানার বিয়ে হয় সদর উপজেলার সুতার গোপ্টাতে। বিশাল আয়োজনে নয়, বরং খুব ছোট্ট পরিসের খানাপিনার আয়োজন করা হয়। মেয়েকে তুলে দেয়া হয় ছেলের হাতে। তারা জানে বেশি জানাজানি হলে বিয়ে বরবাদ হবার আশঙ্কা থাকে।

শাবানার প্রতিবেশী রুমা। ও যখন মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, তখন ওর জন্ম নিবন্ধনে আঠারো বছর পূরণের আর দু’মাস বাকি। তখনি বাবা ইউছুপ বিয়ের আয়োজন করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে খবর গেলে এ আয়োজনটা পণ্ড হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার বাবাকে পুলিশ আটক করে। একসময় মেয়ের বাবা ছাড়া পায়। বিয়েটা তখন হয়নি। যেহেতু ইউএনওর নির্দেশে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুর বয়স কীভাবে আঠারো হয়, সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ১৮ বছর পূর্ণ হলে বিয়ে করতে পারবে, এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে রুমার বিয়ে হয়। রুমা এখন মা। বিয়ের গল্পটা দেড় বছর আগের। এখনও ওই গ্রামে প্রকটভাবে চলছে বাল্যবিয়ে। এ তীব্রতা যেন আরো বাড়ছে। প্রশাসন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বিশেষ তৎপর হলেও ভিন্ন কৌশলে বাল্যবিয়ের দিকে ঝুঁকছেন কেউ কেউ।

আবদুল আলিম। সমাজকর্মী। একটি বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে এলাকার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসনের এসি ল্যান্ড অভিযানে নামে। ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে মুরুব্বিদের থানায় হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু ভিন্ন কৌশলে অন্য এক বয়স্ক মেয়েকে নিয়ে থানায় উপস্থাপন করলে ছাড় পেয়ে যায় অপরাধী চক্র। বিয়েও হয়ে যায়।

চর মার্টিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নোমান হোসেন বলেন, ‘ইদানিং বাল্যবিয়ের সংখ্যাটা বেড়ে গেছে। স্কুলের অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। অনেকে বিয়ের পর আর স্কুলে ফেরেনি। বিশেষ করে নবম ও দশম শ্রেণির মেয়েদের মধ্যে বিবাহিতার সংখ্যা খুব বেশি। অভিভাবকরা তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিচ্ছে। পিতা-মাতার বাইরে তারা কোনো কিছুই বলতে পারে না। আমরা যদি কোনো খবর পাই, তাহলে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেও কোনো কূল পাই না।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমতিয়াজ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বাল্যবিয়ের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। যে কেউ এ অপরাধে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা অত্যন্ত আন্তরিক বাল্যবিয়ে রোধে। তবে সচেতনতা বাড়ানো খুব জরুরি। সরাসরি বাল্যবিয়ের আয়োজনের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে গেলে ওই সব মানুষকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। এজন্য সচেনতার মাধ্যমে যদি বাল্যবিয়েটা রোধ করা যায়, তাহলে আগামীর শিশুরা নিরাপদ থাকবে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়