ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গুগল ডুডলে শেখ দীন মোহাম্মদ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২২, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গুগল ডুডলে শেখ দীন মোহাম্মদ

শাহ মতিন টিপু: শেখ দীন মোহাম্মদ। তিনি প্রথম ভারতীয় লেখক হিসেবে ইংরেজিতে একটি বই প্রকাশের পাশাপাশি ব্রিটেনের প্রথম ভারতীয় রেস্টুরেন্টেরও মালিক। ১৭৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি বইটি প্রকাশ করেছিলেন।

তাকে আজ স্মরণ করে গুগল ডুডলে বিশেষভাবে সম্মান জানিয়েছে।

‘দ্য ট্র্যাভেলস অফ দীন মহম্মদ’ ছিল তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। বইটিতে সেনাবাহিনীতে তার সময় উল্লেখ করেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় শহর ও সামরিক প্রচারের বর্ণনা করেন। বইটি চেঙ্গিস খান, তৈমুর এবং বিশেষ করে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের প্রশংসা নিয়ে শুরু হয়। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং স্থানীয় ভারতীয় শাসকদের সাথে সামরিক সংঘাতের একটি সিরিজ বর্ণনা করা হয়।

বইটি দুষ্প্রাপ্য। এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে কয়েকটি মাত্র কপির সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম খণ্ডের পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯০+৩২, দ্বিতীয় খণ্ডের ১৬২+২০।তিনি শুধু বই লিখেই ক্ষান্ত হন নি। রীতিমত পণ করে মাঠে নেমেছিলেন যে এই বই পশ্চিমাদের পড়িয়ে ছাড়বেন। ফলে নিজে পাবলিশ করে আজকের মতো কর্ক একজামিনার ডেইলিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করেছিলেন। মানুষ হুমড়ি খেয়ে তা কিনেছিল। বিশেষ করে যারা সেসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে উপমহাদেশে আসত। এই বই ছিল তাদের কাছে এক মূল্যবান সম্পদ। কারণ এতে তাঁর ভারতীয়দের নানা দিক সম্পর্কে অবগত হত।

তাঁর ঢাকার বিবরণ পড়লে মনে হবে যে, শহরটির সঙ্গে দীনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। ঐতিহাসিক সিরাজুল ইসলামের ধারণা তিনি বাংলার মানুষ এবং পূর্ব বাংলারই।

দীন মোহাম্মদের ১৭৮৩ সালের ঢাকা ঘুরে যাওয়ার বিস্তারিত রয়েছে তাঁর বইয়ের ৩৬ নাম্বার পত্রে। সেখানে লিখেছেন:

আমরা ঢাকায় পৌঁছিলাম, বাংলা প্রদেশের সব থেকে বড় শহরগুলোর একটি, গঙ্গার একটি পূর্ব শাখা নদীর তীরে অবস্থিত। শহরটি প্রস্থে সরু, কিন্তু প্রায় পাঁচ মাইল লম্বা ও নদীপথের অনুসারে আঁকাবাঁকা। ঢাকা সোনা, রুপো ও রেশমের সূচিকার্যের জন্য বিখ্যাত।

সুতি কাপড় ও সূক্ষ্ম ডোরাকাটা আর কাজ করা মসলিন ইত্যাদি তৈরি হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় যা তৈরি হয় তার থেকে অনেক ভালো। সূচের কাজ সব বর্ণনার অতীত, ইউরোপে যা হয় তাঁর চেয়ে অনেক গুণে ভালো এবং লক্ষণীয়, তা মহিলারা করে না, করে পুরুষেরা, তাদের ধৈর্য আশ্চর্যজনক। (অনুবাদঃ অরুণ নাগ, দীন মোহাম্মদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, দেশ)।

আবার ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন: শ্যামসুন্দর নবাবের এক বজরার নাম। এক বিশাল আকৃতির আকর্ষনীয় কারুকার্য খচিত এ নৌকা। ভেনিসের নরপতি যেমন গদি দখলের দিনটি উদযাপন করেন নদীতে নৌবিহার করে, তেমনি ইউরোপের ভেনিস ঢাকায়ও নবাব তাঁর গদি আরোহণের দিনটি উদযাপন করে থাকেন শ্যামসুন্দরে চড়ে নদীতে উৎসব করে।

শ্যামসুন্দর নামের বজরাটি রূপার পাত দিয়ে মোড়ানো। নৌকার মধ্য ভাগে একটি প্লাটফর্মে একটি বেদি স্থাপন করা হয় রূপা দিয়ে মোড়াই করে। বেদিটির চারপাশে সাজিয়ে স্থাপন করা হয় নৌকার নইলচা। মাথার উপরে শামিয়ানা হিসেবে স্থাপন করা হয় একটি সুসজ্জিত সোনার জরির চাঁদোয়া। চাঁদোয়ার নিচে তাকিয়ায় কনুই রেখে আরামে আসন নেন নবাব। শ্যামসুন্দরের সাজ-সজ্জা, মাঝি-মাল্লা প্রভৃতি বাবদ খরচ হয় লক্ষাধিক টাকা। (অনুবাদঃ সিরাজুল ইসলাম, ঐতিহাসিকের নোটবুক)।
 


তার জন্ম ১৭৫২ সালে ভারতের পাটনায়। বাবা মারা যাওয়ার পর ১০ বছর বয়সে তাকে ব্রিটিশ সেনা অফিসারের অধীনে ডেকে আনা হয়।

তিনি ১৮৫১ সালে ৯১ থেকে ৯২ বছর বয়সে ব্রাইটনে মারা যান।

চুলের যত্নের অপরিহার্য উপাদান ‘শ্যাম্পু’। একসময় বিশ্ববাসী জানতো না চুলের যত্ন কিভাবে নিতে হয়, কী এই শ্যাম্পু, কিভাবে এটা দিয়ে নিতে হয় চুলের যত্ন। শ্যাম্পু করার আগে কখনো কী ভেবেছিলাম যে, এর উদ্ভাবক কোনো এক বাঙালি সন্তান হতে পারে? হয়তো না। কিন্তু সত্যিই, ইংরেজরা এখন ‘শ্যাম্পু’র পুরো কৃতিত্ব নিলেও এই উপকারী প্রসাধনির উদ্ভাবক এক মুসলিম বাঙালি। যার নাম শেখ দীন মোহাম্মদ।

শেখ দীন মোহাম্মদের কাছেই বৃটেনের ইংরেজরা প্রথমে জানতে পারে চুলের পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়। পয়সা খরচ করে সে সময় দীন মোহাম্মদের কাছে অভিজাত ইংরেজরা আসতো ‘শ্যাম্পু’ করতে। এই ‘শ্যাম্পু’ নামটাও বাঙালি মুসলিম শেখ দীন মোহাম্মদেরই দেয়া। যা এসেছে হিন্দি ভাষা ‘চ্যাম্পু’ থেকে, অর্থ হলো মালিশ। এই মালিশের জন্যই ঊনবিংশ শতকে দীন মোহাম্মদ ছিলেন বৃটেনের এক বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব।

১৮১০ বৃটেনের ব্রাইটনে দীন মোহাম্মদ খোলেন একটি স্নানাগার, যেখানে তিনি বিভিন্ন কৌশলে ইংরেজদের শেখাতেন কিভাবে গোসল করতে হয়, কিভাবে নিজের পরিচর্যা করতে হয়। ইংরেজদের তিনি বিভিন্ন রকমের মালিশ দিতেন, যার বিনিময়ে তিনি মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক নিতেন। এক সময় দীন মোহাম্মদের ডাক আসে ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জর্জ এবং রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের কাছ থেকে। শেখ দীন মোহাম্মদকে রাজকীয় শ্যাম্পু সার্জন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভেষস গাছপালার বৈজ্ঞানিক উপায়ে “Britain’s First Indian Massage Parlor’ এ থেরাপির ব্যবস্থা করেছিলেন পশ্চিমাদের জন্য। যার জন্য তাকে ডাকা হত ব্রাইটন সার্জন (Dr. Brighton) । তাঁর এই গোসল করার কৌশল এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ইউরোপের অন্য দেশের রাজা-বাদশারাও দীনের ভেষজ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আসত। কেট এলমস এর লেখায় দেখা যায় এমনি একজন পোল্যান্ডের প্রিন্সেস Poniatowsky শুধুমাত্র বাথিং এর জন্য ব্রাইটনে এসেছিলেন এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

তিনিই প্রথম ভারতীয় তথা দক্ষিণ এশীয় যিনি পশ্চিমা দেশে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক কথার ব্যাপক প্রচলন করেছিলেন। নানারকম সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দক্ষিণ এশীয়দের রাস্তাটি প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর করে গিয়েছেন। আজকে বৃটেনের ৩ মিলিয়নেরও বেশি উপমহাদেশের লোকজনের মাথাউঁচু করে বসবাসের প্রথম ইট তিনিই গেঁথেছিলেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জানুয়ারি ২০১৯/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়