ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উষ্ণতার দেয়ালে মানবতার জয়ধ্বনি

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উষ্ণতার দেয়ালে মানবতার জয়ধ্বনি

মামুন খান : এই তো সেদিনের কথা। হেঁটে অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম । যাওয়ার পথে বায়তুল আজিম শহীদী জামে মসজিদের পাশের একটি দেয়ালে চোখ আটকে গেলো। সেখানে লেখা ‘উষ্ণতার দেয়াল’। লেখার নিচেই হ্যাঙ্গারে ঝোলানো পুরাতন কাপড়। তখন বিকেল সাড়ে ৩টা।

ঢাকা নগরীতে দিন দিন বাড়ছে মানুষ। এখানে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যাদের ঠিকানা ফুটপাত, স্টেডিয়ামের বারান্দা কিংবা খোলা আকাশের নিচে সড়ক দ্বীপ। যারা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বস্ত্রের অভাবে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের সহায়তার জন্য এই উষ্ণতার দেয়াল।

উষ্ণতার দেয়াল আসলে কি- সেটা বোঝার জন্য এর কাছেই নীরবে দাঁড়ালাম।কিছুক্ষণ পরই দেখলাম এক যুবক একটা শার্ট সেখানে হ্যাঙ্গারে রেখে চলে যাচ্ছেন। আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বললাম। নাম তার জমির উদ্দিন, ঢাকা  কলেজের ছাত্র।  সে এবং তার বন্ধুরা এই দেয়ালে কাপড় রেখে গেছে এর আগেও।

গরীব মানুষকে শীতের কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস কাউন্সিল নামের একটি সংগঠন। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে অনেকে।

কিছুক্ষর পর দেখা গেলো ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা একটি সোয়েটার হাতে নিয়ে গায়ে পড়ে চলে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো নাম করিম মিয়া । থাকেন হাতিরঝিলের পাশে। বাড়ি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জে। কিছুক্ষণ পর এলেন ছেঁড়া মলিন শার্ট পড়া নেশাগ্রস্ত এক যুবক। নাম রিন্টু, সে নিলো একটি শার্ট। তার সঙ্গে কথা বলা গেলো না। কারণ, কথা বলার আগ্রহ তার ছিলো না। এভাবে কেটে গেলো আধা ঘণ্টার মত। 

একই সময় মায়ের হাত ধরে এলো শিশু ইমতিহান। রাজধানীর গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী সে। রেখে গেলো একটা প্যান্ট আর কয়েকটা জামা। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে দুটি থলে নিয়ে এলেন এক তরুণী। থলে থেকে কাপড় বের করে সেগুলো রাখলেন দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হ্যাঙ্গারে। তার নাম আশফিয়া। তিনি নিয়ে এসেছেন কয়েকটি প্যান্ট, শার্ট ও শীতের গরম কাপড়। যেগুলো তিনি তার এলাকায় কয়েকদিন ধরে সংগ্রহ করেছেন।

শীতের কাপড় গায়ে চাপিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বৃদ্ধ করিম মিয়ার অনুভুতি জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘টিয়া (টাকা) নাই, তাই শীতের কাপড় কিনতে হারি নো। ইয়ানতুন লই যায়।’ একজনের কাছ থেকে শুনে তিনি এখানে এসেছেন।

প্রতিদিনই এখানে শীতের কাপড় ও অন্যান্য বস্ত্র দিয়ে যান অনেক মানুষ। আর বিনামূল্যে এগুলো নিয়ে যায় সুবিধা বঞ্চিত শিশু ও নানা বয়সের দরিদ্র মানুষরা।

স্থানীয় কলা বিক্রেতা আনোয়ার হোসেনের দৃষ্টিতে এই উদ্যোগ তার ৬০ বছরের জীবনে দেখা সবচেয়ে মহৎ কাজ। মানুষের কল্যাণে এমন চিত্র দেখে তার মন জুড়িয়ে যায়। তিনি নিজেও কয়েকটি জামা সংগ্রহ করে ঝুলিয়ে দিয়েছেন।

উষ্ণতার দেয়ালের সাংগঠনিক সম্পাদক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী  রুম্মান খায়রুল লিখন বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১১ সালে এ সংগঠনের যাত্রা শুরু। সারাদেশে সংগঠনের সদস্য দুই হাজারের বেশি। সবার সহযোগিতায় ভালভাবেই চলছে সংগঠনের কার্যক্রম।’

তিনি বলেন, ‘রাজধানীর মালিবাগ, খিলগাঁও, ভাসানটেক, মিরপুরসহ ১০টি জায়গায় ‘উষ্ণতার দেয়াল’ গড়ে তুলেছি। এ ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় শীতবস্ত্র বিতরণ করতে যাই আমরা। আগামী ২৩ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গিতে শীতবস্ত্র বিতরণ করতে যাবো।’

এ কার্যক্রম কতদিন চালিয়ে যাবেন জানতে চাইলে রুম্মান খায়রুল লিখন বলেন, ‘সময়টা এখন আমাদের। মানুষের যতদিন এই সমস্যা দূর না হবে ততদিন সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আশা রাখি।’

উষ্ণতার দেয়ালের মতই চিত্র বর্তমানে দেখা যায় রাজধানীর অনেক জায়গায়।

গত শনিবার বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় দেখা যায় একই রকম আরো একটি উদ্যোগ। এখানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মানবতার দেয়াল’ নাম দিয়ে শীতার্ত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য বিনামূল্যে কাপড়ের ব্যবস্থা করেছে। কাছেই সংগঠনের কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, তাদের সদস্যরা বিভিন্ন বাসা থেকে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে এনে অফিসে জমা করেন। তারপর সেগুলো মানবতার দেয়ালে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এই সংগঠনটির সদস্যরা রাতে কমলাপুর রেলস্টেশনেও শীতার্তদের মাঝে শীত বস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করেন। ডিসেম্বর মাস থেকে এই মানবতার দেয়ালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

আসুন, আমরা সকলে কিছু মানুষের সুখের কারণ হই- এই স্লোগানে রাজধানীর মানিকদীতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সুখীকরণ দেয়াল’।

এ প্রসঙ্গে টিকাটুলির বাসিন্দা দৈনিক ইনকিলাবের মফস্বল সম্পাদক আলম শামস জানান, শীতকালে অনেক পথ শিশু ও অভাবগ্রস্ত মানুষকে শীতের কাপড়ের অভাবে কষ্টে ভুগতে দেখা যায়। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীত বস্ত্রের অভাবে চরম কষ্টে দিন কাটান। দরিদ্রদের শীত নিবারণ ও পরিধেয় বস্ত্রের যোগান দিতে বিভিন্ন সংগঠন এ মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে। শীত পেরিয়ে গেলেও তাদের এ কার্যক্রম চালু রাখা দরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা মিডিয়ার কর্মীরাও এসব ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি এবং এতে অংশ্রগ্রহণ করছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এসব সংগঠন নিরাপদ সড়ক, মাদক প্রতিরোধ, সুবিধাবঞ্চিত শিশু, প্রতিবন্ধী, মেধাবী অথচ গরীব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খরচও বহন করে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে কাজ করে। শীতের শুরুতে তারা মানবতার দেয়ালের কার্যক্রম শুরু করে । এসব উদ্যোগের সঙ্গে সব সময় তরুণ সমাজ জড়িত থাকে তাই সফলতাও আছে। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। এই কাজে সম্পৃক্ত হয়ে সময়-সুযোগ মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমার সহকর্মীরাও কাপড় সংগ্রহ করেন।’

কবি আলম শামস উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘উষ্ণতার দেয়ালে মানবতার জয়ধ্বনি ফুটে উঠছে।’

শীতকালে দরিদ্র মানুষের মাঝে সরকারিভাবে কম্বল ও শীতের কাপড় বিতরণ করা হয়। তারপরও অনেক মানুষ শীতার্ত থেকে যায়। সচেতন মানুষ যদি এভাবে এগিয়ে এসে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ায় তাহলে এই সুবিধা বঞ্চিতরা কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জানুয়ারি ২০১৮/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়