ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অন্যরকম এক গ্রাম, চলছে স্বপ্ন বুননের কাজ

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অন্যরকম এক গ্রাম, চলছে স্বপ্ন বুননের কাজ

রফিকুল ইসলাম মন্টু: রাত আটটা বাজতে চলেছে। চারদিকে নীরব-নিস্তব্ধতা। রাতের খাবার শেষে অনেকে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু সৌরবাতির আলোয় তখনও জেগে গ্রামের একমাত্র সাইক্লোন শেলটার। কিচিরমিচির শব্দে মেতে আছে শ’খানেক স্কুল পড়ুয়া শিশুকিশোর। সবারই অপলক দৃষ্টি বড় পর্দায়। কখনো সংলাপ, কখনো গান। চলছে শিক্ষামূলক ছবি-কার্টুন। কক্ষের দেয়ালে ছোট সাইনবোর্ড- ‘ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সহায়তা’। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সন্ধ্যা হলেই শিশুকিশোরদের এখানে আসর বসে।

দুর্যোগ আর নানান বিপদাপন্নতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুকিশোরদের সচেতন করা আর শিক্ষায় সহায়তার লক্ষ্যেই নেয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ। স্কুলের বাইরে রাতে বাড়িতে পড়ার সুযোগ এই শিশুদের ছিল না, ওরা কল্পনাও করেনি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এসব শিখতে পারবে। আলাপ হলো কয়েকজনের সঙ্গে। সুন্দরবন সম্পর্কে বেশ ধারণা ওদের। এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো গাছের নাম, প্রাণীর নাম বলে দিল। আনন্দ আর খেলাচ্ছলে ওরা শিখছে অনেক কিছু। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ, পরিবেশের প্রাথমিক ধারণাগুলো ওরা এখান থেকে পাচ্ছে। 
 


এটা অন্যরকম এক গ্রামের গল্প। যে গ্রামে এখনও চলছে স্বপ্ন বুননের কাজ। নির্মিত হয়েছে সাইক্লোন শেলটারের মত স্থাপনা। বসেছে মধু প্রক্রিয়াজাত কারখানা, তৈরি হয়েছে কৃষি প্রদর্শনী প্লট। পুকুর কাটার কাজও প্রায় শেষ। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের হরিনগরের মথুরাপুর জেলেগ্রামের পাশেই এসব কাজ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য কমিউনিটির উন্নয়ন, টেকসই জীবিকায়ন। এখানে ঝুঁকিতে রয়েছে বনজীবীরা। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে বনে জীবিকার পথ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। মথুরাপুর জেলেগ্রামের মানুষের সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। একদিকে আর্থিক সংকট, অন্যদিকে সামাজিক অন্যান্য সমস্যা।           হরিনগর বাজার থেকে মথুরাপুর গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে নদীভাঙন রোধে জেলেগ্রামের পাশ ঘিরে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনি। ফলে বাড়িগুলো রক্ষা পেয়েছে ভাঙন থেকে। গ্রামের ভেতরে খানিক এগোলে রয়েছে ‘টেকসই জীবিকা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। এখানে বনজীবীদের বিকল্প কাজের সুযোগ তৈরিতে দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। ঘরের কাছেই সৃষ্টি হচ্ছে কাজের ক্ষেত্র। সুন্দরবনের মধুভিত্তিক কারখানা গড়ে উঠেছে। স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে সহায়তা। এভাবে বাস্তবসম্মত ছোট ছোট উদ্যোগের মধ্যদিয়ে বড় পরিবর্তনের আশা জাগছে। ঋণ কিংবা অন্য কোনো অর্থ সহায়তা নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে টেকসই জীবিকায়নের স্বপ্ন।

মথুরাপুর জেলেগ্রামে একটি বড় সমস্যা ছিল নদী ভাঙন। বাঁধের ভেতরে ও বাইরের বাসিন্দারা বর্ষা মৌসুমে চরম ঝুঁকিতে বাস করতো। এই সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায়। আর্থিক সহায়তা না দিয়ে কাজটিই করে দেয়া হয়। নদীর তীরে এমনভাবে পাইলিং দেয়া হয়, যাতে ভাঙন রোধ হয়। আর এই কাজে জেলেগ্রামের বাসিন্দারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। জেলেগ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত হয় একটি গ্রুপ। এদের দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। সদস্যরা এখানে সঞ্চয় করে। সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে গ্রুপের তহবিল বাড়ানো হয়। এ টাকা দিয়ে সদস্যরা ব্যবসা করে। এই গ্রামের বাসিন্দাদের বিকল্প জীবিকায়নের লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে আরও কিছু উদ্যোগ। টাকা না দিয়ে কীভাবে টেকসই জীবিকায়ন নিশ্চিত করা যায়- এগুলো তারই দৃষ্টান্ত। জেলেগ্রামের বাসিন্দাদের অনেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে গেলেও এখানে মধু প্রক্রিয়াজাতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামের পাশেই সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানেই প্রক্রিয়াজাত হয়ে প্যাকেটজাত হচ্ছে ‘মৌয়াল’ মধু। সম্প্রতি এই গ্রামে এসেছে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণের আরও উন্নত মেশিন। এখন শুধু মধু প্রক্রিয়াজাত নয়, মধু দিয়ে তৈরি হবে চকলেট। একাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে জেলেগ্রামের ঝুঁকিতে থাকা মানুষেরা।
 


জেলেগ্রামে সাইক্লোন শেলটারের সামনের খোলা জায়গায় টেকসই জীবিকায়নের আরেক উদ্যোগ চোখে পড়ে। এখানে বিভিন্ন ধরণের সবজির আবাদ করা হয়েছে। বিভিন্ন সবজির প্রদর্শনী প্লট করে দেয়া হয়েছে। এগুলোর দায়িত্বেও থাকবে জেলেগ্রামের বাসিন্দারা। সবজি বাগানের পাশের পুকুরে হবে মাছ চাষ। মথুরাপুর জেলেগ্রাম ঘুরে জানতে পারি, সেখানকার মানুষ অত্যন্ত কষ্ট করে সুন্দরবনে গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। বাঘের ভয়, দস্যুর ভয়, দুর্যোগের ভয় উপেক্ষা করেও জীবিকার জন্য সেখানেই যেতে হয় তাদের। এমনকি পুরুষের সঙ্গে ঘরের নারীরাও সুন্দরবনে ঝুঁকি নিয়ে কাজে যান। বাড়ির পাশের এইসব ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ পেলে তাদের বন নির্ভরতা অনেকটা কমে আসবে। দুর্যোগে আশ্রয় নেয়ার মতো আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না গ্রামে। পাশাপাশি জেলে কমিউনিটির অনুষ্ঠানাদির জন্য ছিল না স্থান। এজন্য প্রথমে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করে দেয়া হয়। পরে তৈরি হয় একটি সাইক্লোন শেলটার। কমিউনিটির অনুষ্ঠানাদি, কোনো আত্মীয়স্বজন এলে থাকার ব্যবস্থা হয় টিনশেড ঘরটিতে। দুর্যোগ এলে কমিউনিটির সকলে আশ্রয় নিতে পারেন সাইক্লোন শেলটারে। বাড়তি সুযোগ হিসেবে ওই সাইক্লোন শেলটারে প্রতি সন্ধ্যায় পড়ছে জেলেগ্রামের শিশুরা। মথুরাপুর জেলেগ্রামের শিশুরা স্কুলে গেলেও ওদের লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল না। এমনকি ছিল না প্রয়োজনীয় স্কুল ড্রেস। গ্রামের স্কুলগামী সকল শিশুর জন্য তৈরি করে দেয়া হয়েছে স্কুলড্রেস। অন্যদিকে সন্ধ্যার পরপরই ঘুমিয়ে পড়া জেলেগ্রামের শিশুদের বাড়িতে লেখাপড়া খুব একটা হতো না। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সন্ধ্যার পর সাইক্লোন শেলটারে ওদের বিশেষ শিক্ষা সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হয়। সুন্দরবন লাগোয়া জেলেগ্রাম মথুরাপুরে এসব ব্যতিক্রমী সহায়তা নিয়ে এসেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘বেডস’। পুরো নাম বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। যে কাজগুলো ইতিপূর্বে হয়নি- এমন সব কাজের মধ্যদিয়ে বিপন্ন মানুষের ঝুঁকি মোকাবেলায় সহায়তা করছে এই প্রতিষ্ঠান। মথুরাপুর জেলেগ্রামের বাসিন্দাদের অনেকেই জানালেন, এই কাজের ফলে তাদের জীবনে নতুন স্বপ্ন আশা জাগাচ্ছে। নদীর ভাঙন রোধ হওয়ায় এখন তারা নিরাপদ। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল পেলে কোথাও আশ্রয় নেয়ার জায়গা ছিল না। এখন সাইক্লোন শেলটারে যেতে পারেন, জানালেন গ্রামের বাসিন্দারা। বেডস-এর কাজসমূহ সম্পন্ন হলে তাদের আয়-রোজগারেও সুবিধা হবে বলে আশাবাদী এখানকার লোকজন।

এক সময় সুন্দরবনের ঝুঁকিপূর্ন পেশায় ছিলেন মথুরাপুর জেলেগ্রামের বাসিন্দা আশীষকুমার মণ্ডল। তিনি এখন কাজ পেয়েছেন বেডস-এ। এখানে কাজের সুযোগ পেয়ে তার অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে। আশীষ জানালেন, এখানকার মানুষের অনেক ঝুঁকি ছিল। এখন সে ঝুঁকি অনেকটা কমে এসেছে। সুন্দরবনের ঝুঁকিপূর্ন পেশায় না গিয়ে আমরা যাতে ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারি, সে ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে। ফলে আগামীদিনে আমাদের সামনে নতুন আশা জাগছে। বেডস-এর ব্যতিক্রমী উন্নয়ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর সুশান্ত বিশ্বাস বলেন, আমরা টেকসই জীবিকায়নের স্বপ্ন দেখছি। জীবিকার ক্ষেত্রে এখানকার বনজীবীরা নানামূখী সংকটের মধ্যে জীবিকা নির্বাহ করতো। প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়েই আমরা তাদের পাশে এসেছি। অর্থ না দিয়ে আমরা তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। যেটা প্রয়োজন সেটাই আমরা করে দেয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের প্রত্যাশা এক সময় এ গ্রামটি মডেল গ্রামে পরিণত হবে। আর তখনই আমাদের কাজ শেষ হবে। টেকসই জীবিকায়ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে বেডস-এর প্রধান নির্বাহী মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, বনজীবীদের বিকল্প এবং টেকসই জীবিকায়নের লক্ষ্যেই আমাদের এ উদ্যোগ। এটি নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগসহ আরও অনেক বিষয়ে মনোযোগ দিতে হয়। আমরা ছোট আকারে সে কাজগুলো করার চেষ্টা করছি। মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যেসের পরিবর্তন ঘটানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও আমরা একটা ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখি। আশারাখি, এখানকার মানুষেরা বিকল্প জীবিকায়নের মাধ্যমে সাচ্ছন্দ্যে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।         





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়