ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দ্বীপ গোলাখালীর ঘোলাটে জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্বীপ গোলাখালীর ঘোলাটে জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু: সুন্দরবনের গা ঘেঁষে জেগে থাকা ভয়াল দ্বীপ গোলাখালীর গল্পটা বলার আগে ফিরোজা বেগমের পরিচয় দেয়া যাক। পুবের আকাশে সূর্য আভা ছড়াতে না ছড়াতেই কাজ শুরু হয় তার। এ-পারে অপেক্ষা, ও-পারে অপেক্ষা। কখন আসবে যাত্রী! মিলবে দু’চার টাকা। এভাবে সারাদিনে শ’খানেক কিংবা শ’দেড়েক টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরেন। এটাই রোজগার, এই টাকায় চলে তার সংসার। 

গোলাখালী যাবো। দাঁড়িয়ে আছি এ-পারের খেয়াঘাটে। অপেক্ষা কখন আসবে খেয়া। আসছে না, আরও অপেক্ষা। অবশেষে, খানিক পরে ও-পার থেকে ছোট্ট নৌকা এগিয়ে আসতে দেখলাম। আসছে এ-পারের দিকে। দূর থেকে বোঝা যায়নি নৌকাটি চালাচ্ছেন নারী। কাছ আসতেই বোঝা গেল। এক নারীর দক্ষ হাতে বৈঠা। নৌকা চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না। নৌকা ভিড়ল। অপেক্ষমান যাত্রীরা নৌকায় উঠলেন। সঙ্গে আমিও। নৌকাতেই আলাপ। হ্যাঁ, ফিরোজা বেগমই এই খেয়ার নিয়মিত মাঝি। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তার জীবিকা এটাই। ও-পারে গোলাখালী দ্বীপ। সেখানকার বাসিন্দাদের পারাপারের ভরসা ফিরোজার খেয়া।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রমজান নগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার গাজীর স্ত্রী ফিরোজা বেগম। স্বামী বলতে গেলে অচল। প্রায় কুড়ি বছর ধরে নানান রোগে আক্রান্ত। কোন কাজই তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। নিজস্ব ভিটে বলতে কিছুই নেই। থাকেন রাস্তার ধারের ছোট্ট ঘরে। দু’ছেলেমেয়ে ফারুক হোসেন আর নূর নেছা আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই। অচল স্বামীসহ ফিরোজার সংসারের খরচ যোগাতে হয় তাকেই। তাই খুব ভোরে শুরু হয়  কাজ। সন্ধ্যা নামলে ঘরে ফেরেন। কখনো কখনো দুপুরেও ঘরে ফেরার সময় পান না। নারী হয়েও নৌকা চালানোর মত ব্যতিক্রমী পেশায় থেকেও যেন কোন ক্লান্তি নেই ফিরোজার। পান খেতে খেতে বৈঠা চালাচ্ছেন আর হাসিমুখে জবাব দিচ্ছিলেন সব প্রশ্নের।



খেয়া পার হয়ে ও-পারে উঠলেই গোলাখালী দ্বীপ গ্রাম। রমজান নগর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন এ এলাকাটি সারাবছর ঝুঁকির মধ্যে থাকে। দ্বীপে পা রাখলেই ঝুঁকির চিত্র ভেসে ওঠে। চিংড়ির ঘের মালিকেরা ঘেরের রাস্তা দিয়ে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে এখানকার বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হতে পারবেন না। একদিকে জলোচ্ছ্বাসের ভয়, অন্যদিকে সুন্দরবনের বাঘ, কুমির, সাপের আতঙ্ক। এর ওপর জীবিকার সংকট তো আছেই। বছরের অধিকাংশ সময় থাকে না কোনো কাজ। চলতে হয় ধারদেনা করে। গোলাখালীর পশ্চিমপাড়ার দিকে এগোতেই এগিয়ে এলেন স্থানীয় বাসিন্দা মমিন আলী। তার সঙ্গে আলাপে আলাপে জড়ো হলেন আরও কয়েকজন। 

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকায় সংকট, দুর্যোগে বিপন্নতা- এসব গোলাখালীর প্রধান সমস্যা। খাবার পানির সংকট তীব্র। জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল চিংড়ির পোনা ধরা। ভালোই ছিলেন এখানকার বাসিন্দারা পোনা ধরে। কিন্তু গত কয়েক বছর আগে সেই পোনা ধরায় এসেছে নিষেধাজ্ঞা। ফলে জীবিকায় পড়েছে ভাটা। সুন্দরবনকেন্দ্রির জীবিকা নির্বাহ করেন এখানকার মানুষ। তবে কাজ থাকে না বছরের অধিকাংশ সময়। ধারাদেনা করে চলেন, দোকান থেকে সদাইপাতি আনেন বাকিতে। এই অভাব কাটিয়ে উঠতে এখানকার মানুষ এনজিও ঋণে ভরসা খোঁজে। গোলাখালীর ঘরে ঘরে এনজিও ঋণের বোঝা- জানালেন বাসিন্দারা।

মমিন আলী ঘরের সামনে কথা বলতে বলতে পাশের ঘর থেকে এগিয়ে এলেন ষাটোর্ধ্ব মুনসুর গাজী, সত্তরোর্ধ্ব সোবাহান আলী, পঞ্চাশোর্ধ্ব ছমিরণসহ আরও অনেকে। ভিড় করলো শিশুরা। কেউ স্কুলে যায়, কেউ যায় না। বাসিন্দারা জানালেন, পোনা ধরা নিষিদ্ধ হলেও সেটাই এখনও জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এছাড়া সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরা, মাছ ধরে কেউ কেউ জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে আবার চিংড়ির ঘেরে কাজ করেন। সুন্দরবন লাগোয়া গোলাখালীর জমির পুরোটাই চিংড়ি ঘেরের দখলে। চিংড়ির ঘের আছে বলে এখানে ঘেরের কিনারের রাস্তা দিয়ে মানুষজন হাঁটাচলা করতে পারে। বর্ষায় চলাচলে দেখা দেয় মারাত্মক সমস্যা। বর্ষায় নদীও থাকে উত্তাল। গোলাখালীর পাশের পাঁচ নদীর মোহনা তখন ভয়াল রূপ ধারণ করে।

গোলাখালীতে স্কুল নেই। ছেলেমেয়েরা ও-পারের স্কুলে পড়তে যায়। সমস্যার কারণে অনেকে স্কুল থেকে ঝরে পরে। একবার স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও জমি পাওয়া যায়নি। চিংড়ি ঘেরের কারণে দ্বীপে স্কুল নির্মাণের জন্য এক টুকরো জমিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশেষে গোলাখালী গ্রামের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে কালিঞ্চি গ্রামে। দ্বীপের শিশুরা দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে খেয়া পার হয়ে সে স্কুলে আসে। এখানকার কিছু ছেলেমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, অল্প কয়েকজন মাধ্যমিকে পড়াশুনা করে। তবে নানামূখী প্রতিবন্ধকতায় এখানকার পড়ুয়ারা লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না। অনেকেই মাঝপথে ঝরে পরে। এখানকার মানুষের নেই চিকিৎসার সুযোগ। অসুখ হলে ভরসা হাতুরে ডাক্তার। গ্রামের একজন মাত্র গ্রাম্য ডাক্তারের কাছেই যান গ্রামের মানুষ। কিন্তু জরুরি সমস্যায় তাদেরকে হরিনগর, মুন্সিগঞ্জ কিংবা শ্যামনগর উপজেলা সদরে যেতে হয়। সেসব স্থানে যাওয়াটা সময় সাপেক্ষ।



দুর্যোগ প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বীপের বাসিন্দাদের মনে পড়ে যায় ২০০৯ সালে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আইলার কথা। তারা বলেন, সেই দুর্যোগে এখানকার সব মাটির ঘর ধ্বসে গিয়েছিল। মানুষজন হারিয়েছিল অনেক সম্পদ। আইলার পর আবার নতুন করে ঘর তৈরি করতে হয়েছে। এখনও এখানকার মানুষ ঝুঁকিমুক্ত নয়। গোলাখালীতে আশ্রয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। আশ্রয় নিতে হলে নদী পার হয়ে যেতে হয় ও-পারে। কিন্তু দুর্যোগের সময় উত্তাল থাকার কারণে নদী পার হওয়া কঠিন। দুর্যোগ ঝুঁকি নিয়ে কথা বলতে বলতে সোবাহান আলী ও শহিদুল ইসলাম দ্বীপের পশ্চিম পাশে নিয়ে গেলেন। সেখানে নদীর ভাঙন বসতি ছুঁয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

আর্থিক সংকট এলাকার মানুষকে পিছিয়ে রাখছে। কোনভাবেই তারা এগোতে পারছেন না। প্রায় প্রতিটি ঘর দেনার দায়ে জর্জারিত বলে জানালেন বাসিন্দারা। আলাপের সময় সামনে উপস্থিত আবুল হোসেন ৫ হাজার টাকা, সোবাহান আলী কারিগর ৪৫ হাজার টাকা, মমিন আলী ৪০ হাজার টাকা, ফিরোজ হোসেন ৭ হাজার টাকা, মনছুর আলী ১০ হাজার টাকা, আনছার মোল্লা ১৬ হাজার টাকা দেনা আছেন। এদের অনেকেই মহাজনের কাছ থেকে ঋণ এনেছেন কিংবা দোকান থেকে বাকিতে সদাইপাতি এনেছেন। একজন মাত্র এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। আলাপে জানা গেল, এই দেনা তারা কোনভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। বরং বছরে বছরে দেনার পরিমাণ বাড়তে থাকে।

নিতান্তই নিঃস্ব, বিভিন্ন কারণে সব হারানো মানুষেরা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কোনমতে তাদের জীবিকা টিকিয়ে রেখেছেন। একদিকে কাজ নেই, অন্যদিকে অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপনের মতো সামর্থ্যও নেই। সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন সুবিধাও এদের কাছে খুব একটা পৌঁছায় না। নাগরিক সুবিধা থেকে অনেক দূরে এরা। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা এদের ভাগ্যে জোটে না। তবে নির্বাচন এলে এরা ভোট দেন। এমপি সাহেবকে এরা কখনোই দেখেননি। কেউ কেউ ছবিতে এমপি সাহেবকে দেখেছেন বলে জানালেন। তবে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে দেখেছেন। চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারের কাছে সমস্যার কথা অনেক বলেছেন- সমাধান হয়নি। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সোহরাব হোসেন বলেন, গোলাখালীতে অনেক সমস্যা আছে। যতটা সম্ভব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। আরও বরাদ্দের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। গোলাখালীর বাসিন্দারা নাগরিক সুবিধা চায়। স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায়। তারা বলেছেন, এখানে আমাদের থাকার পরিবেশ নেই। অন্যত্র যেতেও পারছি না। এ দ্বীপের উন্নয়ন করা সম্ভব না হলে সরকার আমাদের অন্যত্র নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। সেইসঙ্গে কাজের সুযোগ করে দিলে আমরা স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়