ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দুধ-মিষ্টির গ্রাম ‘গৈলা’

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২২, ১২ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুধ-মিষ্টির গ্রাম ‘গৈলা’

খায়রুল বাশার আশিক : বরিশালের গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি পিচঢালা পথ সোজা পশ্চিমে চলে গেছে পয়সারহাটের দিকে। সে পথে যেতেই বাসের হেল্পার বাস থামিয়ে চিৎকার করে জানান দিবে, গৈলা-গৈলা… কারা নামবেন নামেন। একটি ছোট্ট বাজার, এ বাজারের নাম গৈলা। এই গ্রামের নামও গৈলা। তবে হাজার হাজার মানুষের কাছে এই গ্রামের অঘোষিত নাম ‘দুধ-মিষ্টির গ্রাম’।

বরিশাল আগৈলঝাড়া উপজেলার এই গ্রামটি খাঁটি দুধ কিংবা দধি- মিষ্টির জন্য বিশ্বস্ত। এখানে নির্ভয়ে খাওয়া যায় মিষ্টান্ন কিংবা গরুর দুধ। গরুর দুধের পণ্য বিক্রি করে এখানকার ব্যবসায়ীরা ঠকায়না কোনো অপরিচিতকেও। কোনো ভেজাল বা চাটুকারিতা নেই বলেই এই গ্রাম ও বাজারটিকে দূর থেকে আগত অনেকের কাছেই যেন এক ‘দুধ-মিষ্টির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে দুধ এবং মিষ্টি খুব পছন্দের একটি খাবার। অতিথি আতিথেয়তায় যার কদর সেই প্রাচীন থেকেই। কিন্তু অঞ্চল ভেদে দধি-মিষ্টির জন্য বিখ্যাত বরিশাল জেলার গৌরনদী। গৌরনদীর দধি-মিষ্টির সুনাম অনেক আগ থেকেই ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে। গৌরনদীর এসব মিষ্টির জন্য দরকার হচ্ছে খাঁটি গরুর দুধ। যে দুধের বড় অংশই সরবরাহ হচ্ছে নিকটস্থ এই গৈলা গ্রাম থেকে।

দধি-মিষ্টির প্রতি এখানকার মানুষের আকর্ষণ অবর্ণনীয়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের নাস্তার তালিকায় এখানে থাকে দধি-মিষ্টি। সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের সংখ্যা এ গ্রামে বেশি। পাশাপাশি গো পালনে অভ্যস্ত গ্রামটির অধিকাংশ মানুষ। এছাড়াও গো-খাদ্য পর্যাপ্ত থাকায় এখানে অধিকাংশ পরিবার গরু পালন করে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে গরুর দুধের পর্যাপ্ততা এখানে অনেক। বড় সব মিষ্টির দোকানগুলোই এই দুধের বড় ক্রেতা। জানা যায়, এ গ্রামে ধর্মীয় কিছু রেওয়াজ ও নির্দেশনার সূত্র ধরে দুধ বিক্রেতা পরিবারগুলো কখনোই দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করেন না বলেই আজ এ গ্রামের দুধ আশেপাশের সর্বত্র সুখ্যাতি অর্জন করেছে।

এ বাজারে নিজস্ব পন্থায় দুধ সংগ্রহ করে প্রতিটি মিষ্টির দোকানে। সকাল হতেই বড়বড় কাড়াইতে দুধ জ্বাল দেয়া শুরু হয়ে যায় এ বাজারের মিষ্টির দোকানগুলোতে। দুধের মিষ্টি গন্ধে মধুময় হয়ে আসে পুরো বাজার এলাকা, সকাল-বিকেল দুইবেলা দুইবার এমন ঘ্রাণ পাওয়া যায় প্রতিদিন।

ছোট্ট এই বাজারটিতে হাতে গোনা কয়েকটি দোকান হলেও প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার দধি-মিষ্টি বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। আবার এখান থেকে অনেক মিষ্টির পাইকাররা দুধ ক্রয় করে। খাঁটি গরুর দুধ বা দুধ থেকে তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন দই, মাখন, ছানা, ঘোল কিনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকেই।

এখানের মিষ্টি ও গরুর দুধের সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পরায় দূর থেকে আসা আগত মেহমান কিংবা দূরপাল্লার বাসযাত্রীরা তাদের পরিবারের জন্য দধি-মিষ্টি ও দুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন একজন ক্রেতা মো আল আমিন, গৌরনদী থেকে যাচ্ছিলেন পয়সারহাটের দিকে, পথিমধ্যে এই হাটের এক মিষ্টির দোকান থেকে ছানা-মাখন খেয়ে বেজায় খুশি তিনি। জানালেন, ‘এই গ্রামের দধি-মিষ্টির সুনাম-সুখ্যাতি শুনেছি অনেকদিন থেকেই, কিন্তু খাওয়া হয়নি আগে। তাই আজ বাস থেকে নেমে সময় করে খেয়ে গেলাম। এখানের মিষ্টি সত্যিই অসাধারণ সুস্বাদু। আর সবাই জানে এখানে কোনো খারাপ খাবার খাওয়ানো হয়না, তাই মানসিক তৃপ্তি পাওয়ার কারণে খাবার আরো ভালো লাগে।’

স্থানীয় যুবক ও ছাত্রলীগ নেতা মো রাহাত হোসেন জানালেন, ‘নীতিগত কারণে এখানের মিষ্টি ও দুধ ব্যবসায়ীরা তাদের দ্রব্যে খারাপ বা কৃত্রিম কোনো কিছুই মেশায় না। এর পেছনে ধর্মীয় কিছু নির্দেশনা ও রেওয়াজ প্রচলিত আছে অনেক আগ থেকেই। এখানে তাজা খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা এখন একটি ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়েছে, যার ফলে অনেকেই মিষ্টি ও দুধের তৈরি খাবার খেতে দূর থেকেও এখানে আসছে।’

ঘোষ মিষ্টি ভাণ্ডারের প্রবীণ মিষ্টি ব্যবসায়ী পরিমল চন্দ্র ঘোষ জানালেন, ‘গ্রামের গোড়াপত্তন থেকে যারা এখানে মিষ্টির ব্যবসা করতো তারা কখনোই খারাপ কিছু মিশিয়ে বেশি মুনাফা বৃদ্ধির চিন্তাও করেনি। আর যারা দুধ বিক্রি করে তারাও ভেজাল দুধ আনেনা। আমাদের বাবা-দাদারা মানুষকে খারাপ মিষ্টান্ন খাওয়ায়নি কোনোদিন, তাই আমরাও খাওয়াই না। ভালো জিনিস বিক্রি করার চিন্তা করি, আশা করি আমাদের বংশধররাও এই চিন্তা মাথায় রাখবে। ক্রেতাকে ভালো খাবার খাওয়ায়ে নিজেও স্বস্তি পাই, ক্রেতায়ও স্বস্তি পায়।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ মার্চ ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়