ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আবজাল দম্পতির আরো দুর্নীতির খোঁজে বিশেষজ্ঞ টিম

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ১৭ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবজাল দম্পতির আরো দুর্নীতির খোঁজে বিশেষজ্ঞ টিম

এম এ রহমান মাসুম : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল এডুকেশন শাখার বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন দম্পতির আরো দুর্নীতির অনুসন্ধানে স্বাস্থ্যের তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করার নির্দেশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি বিষয়ে কাজ করবে ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর গত ৫ মার্চ দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বিশেষজ্ঞ তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত টিমকে আগামি ৩০ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম যাচাই করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনার অধিনস্ত মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনজন কর্মকর্তা সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে টিমের সদস্যদের নাম, পদবী এবং ফোন নম্বর দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে অবহিত করার অনুরোধ করা গেল।

চিঠিতে আরো বলা হয়, গঠিত বিশেষজ্ঞ টিমকে আগামি ২০ মার্চ কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে উপস্থিত হয়ে অনুসন্ধান টিমের সদস্য দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমানের উপস্থিতিতে যন্ত্রপাতি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড যাচাই করে ৩০ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।

এদিকে আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের সম্পদের ক্রোকাদেশ বিলবোর্ড আকারে প্রকাশ্যে স্থাপন করতে আগামি ১৮ মার্চ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে দুদক। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংস্থার পরিচালক (প্রশাসন) জালাল সাইফুর রহমানের সই করা এক চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

কমিটির সদস্যরা হলেন আবজালের দুর্নীতি অনুসন্ধানে নিয়োজিত অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও সংস্থার উপপরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম, উপপরিচালক মো. সামছুল আলম এবং উপপরিচালক (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) এ কে এম মাহবুবুর রহমান।

ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৮ মার্চ রাজধানীর উত্তরায় (বাড়ি নম্বর ৪৭, সড়ক ১১ সেক্টর ১৩) আবজাল দম্পতির বাড়িতে বিলবোর্ড স্থাপনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর আবজাল দম্পতির মালিকানায় থাকা অন্য স্থাপনা ও সম্পদেও বিলবোর্ড স্থাপন করা হবে।

গত ২১ জানুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক অর্থাৎ হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন জব্দ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত।

আদালতের নির্দেশ অনুসারে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান ও বাংলা দৈনিক অগ্রসর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক বরাবর দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয় বলে জানায় দুদক সূত্র।

চিঠিতে আবজাল, তাঁর স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের সব ব্যাংক হিসাবের বিষয়ে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। অভিযোগ ছিল আদালতের আদেশের পর দুই সপ্তাহেই আবজাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম ও অন্যান্য কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত লেনদেন হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি ছিল জব্দের আদেশ সময়মতো না পাওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আবজাল দম্পতি ও তাঁদের সংশ্লিষ্টদের সম্পদ ফ্রিজ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবারও অনুরোধ করে দুদক।

এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি আবজাল, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম এবং তাঁদের ১৫ জন নিকটাত্মীয়ের আরও সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে সংস্থাটি। সুনির্দিষ্টভাবে এই ১৭ জনের সম্পদের খোঁজ চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় চিঠি দেয় সংস্থাটি। তাদের ধারণা, আবজালের যেসব সম্পদের তথ্য তাদের হাতে আছে, তার বাইরেও অনেক সম্পদ রয়েছে। আবজাল দম্পতি তাঁদের নিকটাত্মীয়দের নামে ওই সব সম্পদ করেছেন। তাই ওই সব সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়।

চিঠিতে যাঁদের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়, তাঁরা হলেন আবজাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম, আবজালের ছেলে রুলমান আহমেদ রাকিব, দুই মেয়ে আনিকা সুলতানা রূপা ও আদিবা সুলতানা রথী, শ্বশুর জয়নাল তালুকদার, শাশুড়ি রেহেনা বেগম, তিন শ্যালক রফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম; তিন শ্যালকের স্ত্রী রুমানা, রুমা খান ও লিমা আক্তার; দুই ভাই বেলায়েত হোসেন ও লিয়াকত হোসেন, দুই ভাইয়ের স্ত্রী ঝর্ণা আক্তার ও নাসরিন আক্তার লাকি।

তাদের মধ্যে আবজালের দুই ভাই ও তিন শ্যালককে গত ৩১ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এই পাঁচজনও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত। আবজালের দুই ভাই হলেন ফরিদপুর টিবি হাসপাতালে ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন ও জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারে হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন। তিন শ্যালক হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক রকিবুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী রেজাউল ইসলাম এবং খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম।

দুদক সূত্র জানায়, ১২ ফেব্রুয়ারি দুদকের পক্ষ থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা জেলা প্রশাসক এবং এসব জেলা রেজিস্ট্রারকে চিঠি পাঠিয়ে ১৭ জনের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি দুদকের অনুসন্ধান টিম রাজউক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গিয়ে কথা বলেছেন।

আবজাল হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার প্রাক্তন স্টেনোগ্রাফার। এখন তিনি রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসা করেন।

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন পান সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ চড়েন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। ঢাকার উত্তরায় তার ও তার স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এই দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে গত ১০ জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনা খানমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হলেও তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। এর আগে আবজাল ও রুবিনার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।

আবজাল হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তাঁর। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন তিনি। ২০০০ সালে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তিনি ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি হন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি বর্তমান পদে যোগ দেন।

আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম একই প্রকল্পে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে ব্যবসা শুরু করেন। মূলত স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য তাঁরা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মার্চ ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়