পাল পাড়ায় পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি
অদিতি ফাল্গুনী || রাইজিংবিডি.কম
|| অদিতি ফাল্গুনী ||
বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠি গ্রামের পাল বা কুমোর পাড়ায় যখন ২৫ মার্চ, দুপুর পৌনে একটার দিকে পৌঁছলাম, তখন পাড়ার বাসিন্দারা ছিলেন ভয়ানক ব্যস্ত। না, দুপুরের খাবারের আয়োজনে নয়। সামনে পহেলা বৈশাখ। নর-নারী-শিশু...পাল পাড়ার কারো এখন দম ফেলার সময় নেই। সামনেই সংক্রান্তি আর বৈশাখী মেলা। গ্রামে গ্রামে, ইউনিয়ন ও উপজেলা সদরে, জেলা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে মেলা। পাল বা কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষদেরও এই সময়টুকুই যা বাড়তি আয় করার সুযোগ। একে তো মেলামাইন, কাচ, সিরামিক বা এলুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের কারণে কুমোরদের তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে। তার উপর পহেলা বৈশাখের মেলার সময় মানুষ খানিকটা শখেও যে নানা মাটির দ্রব্য বা নিদেনপক্ষে বাড়ির শিশুদের জন্য পুতুল, বাঘ, হরিণ বা ময়ূরসহ নানা খেলনা কিনে থাকে, তার যোগান না দিলে বাকি বছরটা যে উপবাসে কাটাতে হবে!
‘এ্যামন সময় আইলেন যহন মোরা ব্যস্ত! দম ফেলনের সময় নাই,’ বললেন ৫২ বছর বয়সি গোবিন্দচন্দ্র পাল।
‘মোগো সবাই দ্যাখতে আয়। তাতে লাভ কি? কতো পত্রিকা দিয়া আইয়া ফটো তুললে, চ্যানেল আই দিয়া ক্যামেরা নিয়া আইসা একবার মোগো ভিডিও কইরা প্রচার করলে- য্যা তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি!’ বললেন গোবিন্দচন্দ্র পাল।
কুমোর সম্প্রদায়ের নারী সরস্বতী পাল বললেন, ‘কলসকাঠি গেলে তিনশ'র উপর কুমার ঘর পাইতেন আনে। এইহানে আমরা একটাই কুমার ঘর আছি, দেবর-ভাসুর-জা সব মিলায় ১২-১৫ জন মানুষ। তয় এইটা আমাগো বংশবৃত্তি। নারী-পুরুষ সবাই মাটির জিনিস বানাইতে, রং করতে, আগুনে পোড়াইতে জানি।’
বহুদিন ধরে বাংলার পাল সম্প্রদায় নিয়ে কাজের আগ্রহ থাকলেও নানা কারণেই হয় নি। এবারই একটি বিদেশি সংস্থার সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী এক গবেষণার কাজে বরিশাল জেলার কিছু সংখ্যালঘু গ্রামে কাজের সময় নিজস্ব কৌতূহল থেকেই কুমোর পাড়ায় যাওয়া। অবাক করা বিষয় হলো অন্যান্য সংখ্যালঘু গ্রামের মতো পাল পাড়ায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমস্যা কম। কারণ কী?
‘মোরা ত' মাটির কাজ দিয়াই আয়-বাণিজ্য করি। মোগো ত' ভিটার জমিটুক ছাড়া আর চাষের জমি নাই। জমি না থাকলে গ্রামদেশে কোনো বিরোধই নাই। এছাড়া এখন মাটির জিনিসের দাম শহরে কইমা গেলেও, গ্রামে গরমের দিনে জল ঠান্ডা রাখতে মাটির কলস লাগে। ভাত মাটির হাঁড়িতে রান্ধলে স্বাদ বেশি। কাজেই আমাগো কাছে সবাইর আসা লাগে,’ বললেন অমল পাল।
পালদের কাছে সবচেয়ে বেশি নাকি আসেন ‘মুড়িয়াল'রা। মুড়িয়াল কারা? যারা মুড়ি বানায়। পাল পাড়ার উঠোনে দেখলাম ছোট ছোট ছিদ্র অন্বিত বিশাল মাটির বড়ো বড়ো মুড়ির ধামা।
‘মুড়িয়াল ত' মনে করেন সব মুসলমান। তয় মুড়ি ভালো রাখতে, মচমচা রাখতে এই পাত্রগুলা লাগে। তাই অরাই উল্টা আমাগো খাতির করে। মুড়ির জন্য এই মাটির গামলা তৈয়ার করি আমরা। অরা এইগুলা কিনা বরিশাল-কুমিল্লা-চাঁদপুর-নোয়াখালি নিয়া যায়,’ বললেন অমল পাল।
তবে ইদানীং এলুমিনিয়ামের বিশালাকৃতি গামলা আসায় আবহমান কালের এই মুড়ি রাখার মৃত্তিকার পাত্রের সংখ্যাও কমে এসেছে। ‘আমাগো নাভিশ্বাস উঠছে। ছেলেপানদের অনেকরে আর বংশবৃত্তি শিখাই না। স্কুল-কলেজে পইড়া যদি চাকরি পায়। কুমারদের আয়-রোজগার ত’ সব বন্ধ!’
বিভিন্ন পূজায় কি প্রতিমা বানিয়ে একটু বেশি রোজগার হয় জিজ্ঞাসা করায় একজন জিভ কাটলেন, ‘কি যে কন। যারা পিরতিমা বানায় হ্যারা ধরেন বাসন-কোসন, খেলনা-টেলনা কিছু বানাইবো না। আবার মোরা যারা বাসন-পাতিল, খেলনা-টেলনা বানাই, মোরা কখনো পিরতিমায় হাত দেব না। একটা আচার আছে না?’
সরকার থেকে এই কুটির শিল্পে অনুদান তেমন পান না তারা। ‘সরকারে যদি মোগো কিছু ট্যাহা দিতে- কিংবা শুধু যদি এই প্রচারটা করতে যে মাটির জিনিসপত্রে কোনো দূষণ নাই, শরীরের জন্য ভালো- তাইলেও বাঁচার একটা উপায় হইতো!’
‘কষ্ট ত’ কম না। নৌকায় কইরা নদী থিকা মাটি আনি। মাটিটা নরম কইরা তাল বানানো, একটা কিছু গড়া, রইদে শুকানো, রং করা, রং করার পর আবার আগুনে পোড়ানো- খরচা কি কম?’ জিজ্ঞাসা করলেন সরস্বতী পাল।
সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হওয়ায় কুমোর মেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে যা আগে সম্ভব ছিলো না বলে জানালেন আরেক নারী।
‘পছন্দ হইলে কয়েকটা খেলনা কিনা নিয়া যান। শহরে আপনারা বিদেশি খেলনা কত কেনেন না বাচ্চাদের জন্য?’ কুমোর নর-নারীদের এহেন প্রশ্নে তো বটেই, খানিকটা নিজ বিবেকের তাড়ায়ও মাটির একটি নৌকো, দু’টো ঘোড়া, একটি হাঁস ও চারটি নীল ময়ূর কিনলাম ঢাকায় আমার সেজদার দুই ছেলেমেয়ে এবং আমাদের বাসার গৃহশ্রমিক শিশুটি ও অফিসের তিন সহকর্মীর জন্য। এতগুলো জিনিস মাত্র দুইশ টাকায় দিয়ে একটি মাটির ঘোড়া খুশিতে ফ্রি দিয়ে দিলো তারা। কি সহজ মানুষ এই শিল্পীরা! দেশি শিল্প বলে আমরা পাত্তা দিই না, পৃষ্ঠপোষকতা করি না। মনটা খুবই খারাপ হলো। ‘এতগুলো’ জিনিস নেয়ায়, শেষে একটি বড়ো মাটির ঘোড়ার দাম তারা কিছুতেই নিলো না।
আসুন, নতুন বাংলা বছরে শপথ নিই যেন বাড়ির শিশুদের দামি বিদেশি খেলনার পাশাপাশি এই মাটির খেলনাও আমরা উপহার দিই। স্বদেশি পণ্য বাঁচান, স্বদেশি শিল্প রক্ষা করুন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৯/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন