ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বোশেখ এলো

অমর মিত্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১৫ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বোশেখ এলো

 

তিনি এসে গেছেন রাঙা চক্ষু নিয়ে। তিনি এসে গেছেন রাগী মুখখানি নিয়ে। বৈশাখ মাস। কবির জন্ম মাস। কবিই তাকে ডেকে এনেছেন- এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়ে যায় চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে। সূর্যরশ্মি খাড়াভাবে নামছে পৃথিবীর এই গোলার্ধে। এই মাসকে কেউ সাধ করে ডেকে আনে? কবি তার জন্মমাসকে ডেকেছিলেন পরম ভালোবাসায়। আবেগে। সেই রৌদ্রময় অগ্নিময় বীরভূমে বসেই তো তিনি ডেকেছিলেন বৈশাখকে। গরমকাল সেই যে এলো কার্তিক মাস অবধি যেন চলতে থাকে। মাঝে অনাবৃষ্টি, বৃষ্টি, বন্যা সব এসে যায়, শরৎকাল, কাশফুল, উৎসবের মাস... তার ভিতরেও গরমকাল লুকিয়ে থাকে। আর শীতকাল, তার ভিতরেও। আচমকা শীত চলে গিয়ে দু’দিনের জন্য গরম পড়ে গেল। প্রকৃতি এতো খেয়ালি! আসলে প্রকৃতির ভিতরে এতো জাদু। কিন্তু আমি এখন তার ভিতরেই জাদুবিহীন গরমকালের কথা বলি। ছয় ঋতুর এক ঋতু গ্রীষ্মের কথা বলি। গ্রীষ্মের সূচনা বৈশাখের কথা বলি। বৈশাখেই আমাদের বর্ষ শুরু। কিন্তু নববর্ষ আসে আগুন-রাঙা চোখ নিয়ে। কী হতো কী হয় সব আমরা জানি। কলকাতা শহরের রাস্তায় এখন পিচ গলে না। গলা পিচের ভিতরে নীল রঙের হাওয়াই চটি আটকে পড়ে থাকে না। এক সময় তা হতো। রাস্তা দেখে ধরা যেত যে হতভাগ্যের চটি গেল, তার পায়ের পাতায় কেমন দাগ পড়ল গরমকালের। সেই গরমকালে রাস্তা পার হওয়াই ছিল বিপজ্জনক। রাস্তার সেই হাল গেছে, কিন্তু রোদের তেজ কমেনি। দেশজুড়ে বৈশাখ এসে গেছে। আকাশ নির্মেঘ, দিন প্রলম্বিত হয়েই চলেছে। ভোর হয়ে আলো ফুটে যায় সাড়ে চারটেয়। রোদ উঠতেই চারদিক জ্বলতে আর পুড়তে শুরু করে। সেই জ্বলন শেষ হয় দিনান্তে। আর সমস্ত দিন ধরে চলে হা হা রোদ। তার ভিতরে যদি পশ্চিমী বাতাস, পৈছা বাতাস ঢুকে পড়ে এই দেশে, তখন বেলা দশটার পর সব সুনসান হতে আরম্ভ করে। না, এই কলকাতা শহরের কথা নয়, মফস্বলী বৃত্তান্ত তা। আমি সেই বৃত্তান্তই বলি। পাহাড় টিলায় ঘেরা শালতোড়ায় ভয়ানক গ্রীষ্ম নিয়ে বৈশাখ এলো। কুয়োর জল কমতে কমতে তলানিতে। ভোর থেকে সরকারি কুয়োয় বালতির লাইন। সারারাত চুঁয়ে চুঁয়ে যেটুকু জল জমেছে কুয়োর নিচে কে তুলে নেবে তা। গাঁ, মফস্বল তো টালার মস্ত জলাধারসমেত কলকাতা শহর নয়। গরমকাল মানে জলের অভাব। গঞ্জের হোটেল জলের অভাবেই গেল বন্ধ হয়ে। মালিক গাঁয়ে চলে গেল কর্মচারী তিনজনকে ছুটি দিয়ে। গাঁয়ে কি জল আছে? নেই। কিন্তু তবু আছে। কাঁদর, জোড় আছে। আবার কোথাও জঙ্গলের ঝরনা থেকে বেরিয়ে আসা সামান্য স্রোতস্বিনী আছে। সেখানে বর্ষার দিনে স্রোত হয়, অন্য সময় শুধু বালি। সেই বালি খুঁড়লে জল। খুব ঠান্ডা সেই জল। আমি দীর্ঘ এক গ্রীষ্ম অমন জলে স্নান করেছি, অমন জল পান করেছি। গোপীবল্লভপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে। গ্রীষ্মের দিনে খুব তাড়াতাড়ি কুয়ো যেমন শুকিয়ে যায়, পঞ্চায়েতের বসানো টিউবওয়েলও অচল হয়ে পড়ে থাকে। মফস্বলী গঞ্জের মানুষের চোখ তখন আকাশে। মেঘ হলো কি? আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে, আল্লা মেঘ দে। এক একদিন খবর ওড়ে, দূর কোনো এক গাঁয়ে বৃষ্টি হয়েছে। এক একদিন কেউ বলে, মেঘ হয়েছিল দুপুরের একসময়? কখন কখন? কবে কবে? সে বলল, কথাটা তার শোনা। এক বিকেলে এক ভবঘুরের সঙ্গে আমার দেখা। সে বলে, আপনি স্যার খেয়াল করেছেন কি, আকাশ বেঁকে গিইছে! হ্যাঁ, সে দুপুরভর রাস্তার পাশের নিমগাছের নিচে ঠায় বসে আকাশটাকে খেয়াল করেছে। একেবারে করোগেটেড টিনের ছাউনির মতো হয়ে গেছে, দেখুন ভালো করে দেখুন। রোদ এমন যে তাই-ই হতে হবে। হবেই। গরমকালে মানুষের বায়ু রোগ বাড়ে। সারাবছর ঠিক থেকে গরমের সময় অবধারিতভাবে মাথায় ভুলভাল কথা চাগাড় দেয়। চোখ মরীচিকা দেখতে থাকে। এতো বড় বেলা, এতো দীর্ঘ রোদ ঝনঝনে দুপুর, সূর্যের নড়ন চড়ন বন্ধ, যদি সূর্য আকাশের ওই জায়গায় আটকে যায়, ফিক্সড হয়ে যায়, তখন? রোদ পড়বে না, বিকেল আসবে না, অনন্ত দুপুর চলতেই থাকবে। এই নিয়েই বিলাপ করতে থাকে ভিন গ্রাম থেকে আসা লোকটি।

দেখেছি গরমে বালিভাসা সুবর্ণরেখা নদী পার হতে গিয়ে এক পোস্টম্যানের মৃত্যু। মাথা ঘুরে বালির উপর পড়ে গেল লোকটা। রোদ উঠতেই সোনার নদী থর মরু। এখন সেই নদীর উপর ব্রিজ হয়ে গেছে। তাপপ্রবাহে কতজনের যে মৃত্যু হয় এই অভাগা দেশে। শীতে মরে, গরমে মরে, বন্যায় মরে, মৃত্যুপ্রবাহ চলতেই থাকে। আমি এই যে একটু আগে যে বলেছি প্রকৃতি সবচেয়ে বড় জাদুকর। সেই জাদু দেখেছিল এক ঘোড়া এই ভয়ানক গ্রীষ্মে। দীঘায়, সমুদ্রতীরে থাকতাম এক সস্তার হোটেলে। হোটেলওয়ালার একটি ঘোড়া ছিল। সেই ঘোড়া আশ্বিনে পালাত। দূরে কোথায় সুবর্ণরেখা নদী যেখানে মিশেছে সমুদ্রে, সেখানে একটি সবুজ ঘাসের চর ছিল তার লক্ষ্য। আশপাশের অনেক ঘোড়া আসে ওই সময়। তাদের সঙ্গে খেলা হয়। তারপর হেমন্তের শুরুতে কার্তিকের আরম্ভে সে নিজেই ফিরে আসত। বৈশাখের পূর্ণিমার দিনটা ছিল ভয়ানক। সকালে তার পিঠে চেপে হোটেলওয়ালা গ্রাম থেকে দীঘায় ফিরেছিল। ঘোড়াটি হাঁসফাঁস করছিল রোদপোড়া হয়ে। তারপর দুপুরে মেঘ উঠল ঈশান কোণে। ব্যপ্ত হলো মেঘ। ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। কালবৈশাখী এলো। ঝড়ের পর এলো অঝোর বৃষ্টি। বর্ষায় ঠান্ডা হলো প্রকৃতি। সন্ধেয় পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। চাঁদের আলো পড়ল বালিয়াড়ির খোপে খোপে জমা জলে। আকাশে পালক মেঘ। ঘোড়াটি দেখল আশ্বিন এসে গেছে। একদিনেই দুই ঋতু পার। সে সবুজ ঘাসের চরের ডাক পায়। বিভ্রমে পড়ে সে ছুটল দড়ি ছিঁড়ে। আসলে মৃত্যুর দিকেই ছুটল। রাত পার হতেই তো আবার সেই বৈশাখ, সেই গরমকাল। আগুন ছুটছে বাতাসে। বৈশাখ তবু এসো। গরমকাল তবু এসো। এসো তরমুজ, আম কাঁঠালের সুঘ্রাণ নিয়ে। বিভ্রমে মৃত্যু আছে, আবার প্রকৃতি তাকে দিয়েছেও অঢেল। কচি তালশাঁস, নুন লঙ্কা মাখানো আমের গুটি নিয়ে বৈশাখ এসো। এসে তো গেছেই সে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৯/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়