ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কমলনগর সুরক্ষিত থাকুক

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ২৫ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কমলনগর সুরক্ষিত থাকুক

রফিকুল ইসলাম মন্টু: কমলনগরকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। খবরের খোঁজে বহুবার সেখানে গিয়েছি। প্রায় করতলের মতোই আমার চেনা এখানকার মাটি-মানুষ-প্রকৃতি। রাক্ষুসী মেঘনার ছোবলে বিলীন গ্রামের পর গ্রাম। মেঘনার জলে মিলেমিশে একাকার এখানকার মানুষের চোখের নোনাজল। পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার পরেও শেষ চেষ্টা। অবশেষে জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষগুলো ছুটে চলে নতুন ঠিকানায়। মেঘনাপাড়ের এই গল্পগুলো নিভৃতেই কাঁদে। কাগজে ছাপা হয়, টেলিভিশন পর্দায় ভেসে ওঠে ভাঙনের বিধ্বংসী রূপ। কিন্তু অবস্থা তো বদলায় না। প্রশ্ন জাগে, কমলনগর কী আদৌ টিকবে? কে নেবে সম্ভাবনাময় এই জনপদের সুরক্ষার দায়িত্ব? হ্যাঁ, যে কমলনগরের কথা বলছি, সেটি লক্ষ্মীপুরের মেঘনাতীরের ভাঙন কবলিত উপজেলা। রামগতি থেকে পৃথক হয়ে কমলনগর নামে উপজেলা হয়েছে। কিন্তু উপজেলাটি গত কয়েক বছরে কতটা ছোট হয়ে গেছে, সে খোঁজ কে রাখে?

কমলনগরের এই গ্রামগুলোতে কতবার গিয়েছি, তার হিসাব নেই। বর্ষা মৌসুম আসার আগে বাড়িঘরের চালা সরিয়ে নেওয়া, স্কুলের বেঞ্চ-টেবিল অন্যত্র সরানো, প্রিয় স্বজনের কবরস্থানের হাঁড়গোড় সরিয়ে নেয়ার অনেক দৃশ্য চোখে ভাসে। আতঙ্কিত মানুষগুলো কখনো রাত জেগে পাহারায় থাকেন নদী কিনারে। কখন ভাঙন শুরু হয়, মেঘনার অতলে হারায় সব! অনেকের রাতের ঘুমটুকু আর হয় না। এখন যে শুধু বর্ষায় ভাঙে তা নয়, উপকূলজুড়ে প্রায় সারা মৌসুম ভাঙন অব্যাহত থাকে। বয়োঃবৃদ্ধ অনেকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। আঙুল তুলে নদীর মাঝখানে সীমানা টেনে তারা দেখানোর চেষ্টা করেন সেখানেই ছিল তাদের বাড়ি। ভাঙনের শিকার হয়ে এই জনপদে এসেছিল বহু মানুষ। এখন আবার এটাও ভাঙছে। মানুষগুলো কোথায় যাবে?

উপকূলের বিভিন্ন বিষয়ে ফলোআপ করা আমার কাজের অন্যতম ধারা। সেই ধারায় কমলনগরের কিছু এলাকা, কিছু মানুষের গল্প আমার নোটে লিপিবদ্ধ আছে। ফটোফোল্ডারে আছে বহু ছবি। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ আমি তথ্য সংগ্রহ করি কমলনগরের জগবন্ধু গ্রামের। কী সুন্দর নাম-জগবন্ধু। এ গ্রামেও বসবাস করতেন বহু মানুষ। তাদেরও স্বপ্ন ছিল, প্রত্যাশা ছিল, এগিয়ে চলার উদ্যম ছিল। কিন্তু গোটা গ্রামটিই অনেক আগে বিলীন হয়ে গেছে। এ গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবার সাহেব বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পূর্বদিকের ছবি তুলছিলাম সেদিন। ফটোফোল্ডারে ছবিগুলো বেশ তরতাজা, মনে হয় এখনই তুলে আনা। ইটের রাস্তা, বাঁশঝাড়, দোকান, ঘন বাগান দেখা যাচ্ছে এ ছবিতে। একই স্থানে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে যে ছবি তুলি, তাতে দেখা যায় সাহেব বাড়ির পাকা কবরস্থানের বাউন্ডারি, কাঁচা রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গাছপালা, দোকান, পথিকের হাঁটাচলা, শিশুর স্কুল যাত্রা। একই স্থানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের ছবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাকা ভবন, খেলার মাঠ। মাঠে খেলছে শিশু। জগবন্ধু গ্রামের এই দৃশ্যগুলো এখন অতীত। এই গ্রামের ফরাজীপাড়া জামে মসজিদের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে ক্যামেরার লেন্স রেখে ছবি তুলেছিলাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সবুজ ফসলি মাঠ, মাঠে কৃষক। সয়াবিন ক্ষেতে পড়েছে গাছের ছায়া। দূরে ঝাপসা বাড়িঘর। এগুলো সবই এখন মেঘনার মাঝখানে অথৈ পানির নিচে।   
 


এই উপজেলার লুধুয়ায় ছিল একটি বৃহৎ বাজার, মাছঘাট, হাইস্কুল, মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলকন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাকা ভবনের যে ছবিটি আমার ক্যামেরায়, সে ছবিটি অনেক আগেই অতীত হয়ে গেছে। ফলকন উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলে জেনেছি- প্রায় সকলেই একাধিকবার স্কুল বদল করেছে। ইতিমধ্যে তারা হয়তো আরও কয়েকবার স্কুল বদল করেছে। ওদের অনেকে হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পেরে মাঝ পথেই ঝরে পড়েছে। কে রেখেছে সে খোঁজ? লুধুয়া বাজারের ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকের ছবিতে দেখি একটি সরু শুকনো খালের ভেতরে অসংখ্য মাছধরার নৌকা। এ দৃশ্যটা ব্রীজের উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে ঘোরানো লেন্সেও কিছুটা এসেছে। এতে আরও দেখা যায় বাড়িঘর, ঘরের সামনে রশিতে ঝুলছে শুকোতে দেওয়া কাপড়চোপড়। খালের তীর, নৌকার ভিড় ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো এখন আর কিছুই নেই। মাছঘাট তো দূরের কথা, লুধুয়া বাজারটিই সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যত্র। বহু পুরানো শিমুল গাছ, যার কোটরে টিয়া পাখির আবাস ছিল, সে আবাস থেকে টিয়া বের হওয়ার সময় ছবি তুলেছিলাম, সে গাছটির পতন ঘটেছে, ভাঙনে গোড়ার মাটি সরে গেছে বলে। ছাল-চামড়া তুলে নেয়ার পরও যে অর্জুন গাছটি মানবসেবায় দাঁড়িয়েছিল, সেটি কাটা পড়েছে সেই কবে। এলাকার বাসিন্দারা রাস্তার ওপরের যে মাটিতে আমাকে এঁকে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন এলাকার চিত্র, সে রাস্তা এখন পানির অতলে। যে ঘাটে নারীরা কলসি ভরে পানি তুলতেন, পুকুরের যে পাকা ঘাট ছিল এলাকার মানুষের গোসলের জায়গা, যে মাঠ ছিল শিশুর খেলাস্থল, তা এখন আর নেই।

কমলনগরের খেটে খাওয়া মানুষদের পিছু হটা দেখি বছরের পর বছর। নতুন করে বানানো বাড়িটি এবার আছে তো পরের বার সরাতেই হবে। এক জীবনে আট-দশ-পনেরো বার বাড়ি বদল করলে অবশিষ্ট কী থাকে? সাবেক রামগতি থেকে আলাদা হয়ে কমলনগর স্বতন্ত্র উপজেলার মর্যাদা পেলেও তার সুরক্ষা হয়নি। অথচ এই উপজেলার নাম মনে হলে ভেসে ওঠে ‘সয়াবিন’ শব্দটি। কারণ দেশে মোট উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন এ উপজেলায় উৎপাদিত হয়। সয়াবিন চাষের পদ্ধতি এ এলাকা থেকেই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। সয়াবিনের মৌসুমে এই এলাকার পথ ধরে হাঁটলে মাঠের পর মাঠ সয়াবিনের দৃশ্যপট চোখে পড়ে। চাষিরাও বেশ লাভবান হচ্ছিলেন। কমলনগরের এই সয়াবিনকে ঘিরে লক্ষ্মীপুর জেলার ব্র্যান্ড স্লোগান হয়েছে ‘সয়াল্যান্ড’। কিন্তু সয়াবিনের কারণে এত কিছু, অথচ সয়াবিনের সেই এলাকাটি আমরা রক্ষা করতে পারছি না কেন? মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম, সয়াবিনের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেও এ এলাকাটি সুরক্ষা জরুরি। কমলনগরে প্রবেশ করে যে কোন মানুষের কাছে প্রধান সমস্যা জানতে চাইলে উত্তর আসবে ‘নদীভাঙন’। বিষয়টি নিয়ে আমি অনেকবার লিখেছি। আজ আবার কেন লিখতে হলো- প্রশ্নটি আসতেই পারে। লিখছি কারণ, এলাকাবাসীর এই প্রাণের দাবি সামনে রেখে কমলনগরের বিভিন্ন স্তরের মানুষ গত বুধবার (২৪ এপ্রিল ২০১৯) মানবন্ধন করেছে ভাঙন তীরে। ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে তারা ভাঙন রোধে দাবি জানিয়েছেন। নারীরা ঘরের কাজ ফেলে, পুরুষেরা মাঠের কাজ ফেলে, জেলেরা নৌকার কাজ ফেলে এই মানববন্ধনে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার সময় খানিকটা কমিয়ে মানববন্ধনে এসেছে। ‘কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ’ নামের সংগঠন এই কর্মসূচির ডাক দেয়। এর আগে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনেও মানবন্ধন করেছে কমলনগরবাসী। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্দেশ্য তাদের। মানববন্ধন আয়োজনকারীরা বলেন, অবিলম্বে বাঁধের কাজ শুরু না হলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে কমলনগর ও রামগতি নামের এই দুটি উপজেলা কয়েক বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। ভাঙন রোধের দাবি এখন এই এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি। পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এই এলাকার বহু সম্পদশালী মানুষ পথে বসেছেন। তাই কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ৭ লক্ষ মানুষকে রক্ষায় নদীতীরে বাঁধের কাজ শুরু করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা তাদের।

সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ সালে কমলনগর-রামগতি রক্ষায় ৩৭ কি.মি. বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদিত হয়। প্রথম পর্যায়ে রামগতিতে সাড়ে চার এবং কমলনগর উপজেলায় ১ কিলোমিটার কাজ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। পরে জানা যায়, মেঘনার ভাঙন থেকে রামগতি-কমলনগর রক্ষার পূর্ব প্রকল্পটি গত ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল তারিখে বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর লক্ষ্মীপুর-৪ (কমলনগর-রামগতি) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এলাকায় গিয়েছিলেন। তিনি বলে এসেছেন, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর-রামগতি উপজেলায় মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে বিস্তীর্ণ জনপদ বিলীন হয়ে গেছে। সারাবছর ধরে অব্যাহত ভাঙনে এখানকার মানুষ অসহায়। এ ভয়াবহ ভাঙন রক্ষায় কাজ করা হবে। শিগগিরই ১৪০০ মিটার কাজ করা হবে। এছাড়াও আরও ১৫ কিলোমিটার কাজের জন্য মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু শুধু প্রতিশ্রুতিতে এ এলাকার মানুষের মন ভরে না। এমন প্রতিশ্রুতি তারা আরও বহুবার শুনেছে। বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের খবর শুনতে শুনতে গোটা উপজেলাটাই শেষ হতে চলেছে। অথচ সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা আজও হয়নি। বরং কমলনগরের মাতাব্বরহাট এলাকায় যেটুকু বাঁধ নির্মাণ হয়েছে, সেখানেও এক বছরে ধ্বস নেমেছে। তাহলে এলাকার মানুষের শেষ ভরসা কোথায়? প্রশ্নটা ঝুলেই থাকে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ এপ্রিল ২০১৯/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়