শ্রবণ প্রতিবন্ধীরাও শুনতে-বলতে পারে
নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির মাধ্যমে এখন বিভিন্ন বয়সী শ্রবণ প্রতিবন্ধীরাও শুনতে ও কথা বলতে পারছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫২ জনের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ১৪০ জনই শিশু। ফলে ১৪০ বাবা-মা শুনতে পাচ্ছেন সন্তানের মুখে মা-বাবা ডাক এবং অন্য ১২ জন বিভিন্ন বয়সী শ্রবণ প্রতিবন্ধীও শুনতে ও কথা বলতে পারছেন। আরো ৫০ জনকে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ দেওয়া হবে। এছাড়া আরো ১৮ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-ব্লকের নিচতলায় শহীদ ডা. মিলন হলে দুদিনব্যাপী ৫ম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি বিষয়ক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
কর্মশালায় জানানো হয়, ১৫২ জনের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ সেবা পেয়েছেন ১২৮ জন এবং ২৪ জনকে নিজ অর্থে ক্রয় করা কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস লাগানো হয়েছে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। শুধু ডিভাইসের মূল্য ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। বিদেশে এ ধরনের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারিতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
পঞ্চম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কর্মসূচি পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল হাসনাত জোয়ারদার জানান, বধিরতা বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বধিরতার হার শতকরা নয় দশমিক ছয় ভাগ। দেশে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ মারাত্মক ধরনের বধিরতায় ভুগছেন- যারা সবাই কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের সম্ভাব্য প্রার্থী। বিশ্বজুড়ে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে দুজন শিশু বধিরতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬০০ শিশু বধিরতা নিয়ে জন্মায় এবং প্রায় সমসংখ্যক জনগোষ্ঠী শ্রবণশক্তি নিয়ে জন্মালেও তাদের জীবদ্দশায় কোনো না কোনো সময়ে বধিরে পরিণত হয়। শৈশবে এবং বাল্যকালে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা শিশুর মৌখিক ভাষার বিকাশ এবং মানসিক বিকাশকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তি পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকে। তাই একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধীর দ্রুত শ্রবণ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, মারাত্মক বধিরতা অথবা সম্পূর্ণ বধিরতা যেখানে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করেও কানে শোনা সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে এখন অন্তকর্ণে কক্লিয়ায় স্থাপনযোগ্য জৈব ইলেকট্রনিক যন্ত্র কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অত্যন্ত উপযোগী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অন্তকর্ণে স্থাপন করতে হয়। এই ইমপ্লান্ট শ্রবণ প্রতিবন্ধীর জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। এই ইমপ্লান্ট গ্রহণের মাধ্যমে এক শ্রবণ প্রতিবন্ধী শ্রবণের জগতে প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি আরো জানান, ২০০৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশের হাতেগোনা তিন-চারজন রোগী বিদেশে গিয়ে এই ইমপ্লান্ট সার্জারি করিয়েছেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ২৫টি ইমপ্লান্ট সার্জারি হয়। বাংলাদেশে বর্তমান বাজারে একটি কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের (ডিভাইস) মূল্য ১০ লাখ থেকে ২০ লাখের মধ্যে পড়ে। এছাড়া সার্জারি, হেবিলিটিশন থেরোরি ও বিবিধ খরচে গড়ে কমপক্ষে আরো লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা সাধারণ মানুষের একেবারে নাগালের বাইরে ছিল। তাছাড়াও দেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট টেকনোলজি সহজলভ্য ছিল না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ডেভেলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রোগ্রাম ইন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (১ম পর্যায়ে) নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস প্রদান করা, সার্জারি করে শ্রবণ প্রতিবন্ধীর কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা, হেবিলিটিশন সেবা প্রদান করার শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে ইমপ্লান্ট পরবর্তী সময়ে ভাষা বা কথা বলা শেখানো এবং ইমপ্লান্ট বিষয়ে জনবল তৈরি করা ও টেকনোলজি আহোরণ করা। এ পর্যন্ত সব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সকল অপারেশনও বিনামূল্যে করা হয়েছে। সকল ইমপ্লান্ট গ্রহীতারা কানে শুনতে ও কথা বলতে সক্ষম হচ্ছে।
আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিল্লার রহমান। সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী আসগর মোড়ল প্রমুখ।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম-বিএসএমএমইউর কর্মসূচি পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল হাসনাত জোয়ারদার।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক-কান-গলা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী, ভারতের গঙ্গারাম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আশিষ কুমার লাহিড়ি ও অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ই সি বিনয় কুমার।
কর্মশালায় চিকিৎসক, অডিওলজিস্ট ও স্পিচ থেরাপিস্টসহ ৮০ জন অংশ নিচ্ছেন। কর্মশালায় দেশি ও বিদেশি প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আছেন বলেই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরাও লাখ লাখ টাকার চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পেয়েছে। এর ফলে আজ ওই সব শিশু শুনতে পারছে, কথা বলতে পারছে এবং তাদের মা-বাবার মুখে হাসি ফুটেছে। আজ আর এসব শিশু সমাজের বোঝা নয়।
উপাচার্য বলেন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের কক্লিয়ার ইমপ্লান্টে সহায়তা করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। তিনি বিত্তশালীদের প্রতি এগিযে আসার আহ্বান জানান।
বক্তার বলেন, আজকের কর্মশালা দেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট টেকনোলজি ট্রান্সফার প্রক্রিয়াকে আরো অগ্রায়ণ করবে। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমবে এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা দেশেই সাশ্রয়ে এই আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে।
তারা বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসার জন্য যে চারা গাছটি রোপণ করেছিল আজ তা মহিরূহ আকার ধারণ করেছে। বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক বলেই অত্যন্ত দামি কক্লিয়ার ডিভাইস সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ মে ২০১৭/ সাওন/মুশফিক
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন